বর্তমান ভারতে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ব্যাপক উত্থান। বস্তুত রাষ্ট্রিক আর সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক আচরণ লালিত-পালিত এবং উৎসাহিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীর দ্বারাই। ভয়ের কারণ, ফ্যাসিবাদের পোষক সরকার সাম্প্রদায়িকতাবাদের বীভৎস প্রকাশ সাম্প্রদায়িক একতরফা দাঙ্গার মারফত দেশস্থ বিশেষধর্মী মানুষজনের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তা নিয়ে এই সন্দর্ভ পত্রটি লিখেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
সর্বাত্মক ফ্যাসিবাদ কায়েমের উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দেশের মধ্যে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির মারফত তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ আর এক অতলান্তিক ঘৃণা ছড়াচ্ছে, ঠিক যেমন নাৎসীবাদী হিটলার ইহুদি বিদ্বেষে জারিত করেছিল জার্মান জাতিকে। উৎপীড়ক এই ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর বাহানা বা অজুহাতের শেষ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুধর্মী জনগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের ভয়ানক সাম্প্রদায়িকতাবাদকে জাতীয়তাবাদের সমার্থক করে তুলেছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলা এই জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্য। এটাকে ‘উগ্রজাতীয়তাবাদ’ বা ‘Chauvenism’-ও বলা যায়। জওহরলাল নেহরুর অনুভব হচ্ছে, ‘জাতীয়তাবাদকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে পুরোপুরি পৃথক করা যায় না’। শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণে মুসলমানদের কোণঠাসা করে ফেলতে চাইছে তা নয়। এর পিছনে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, মানসিক আর অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। ফিলহাল ফ্যাসিবাদী মোদি সরকার জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে একই ‘গাড়ুত’-তে ঘেঁটে দিয়েছে। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাঁর ‘মর্ডান ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ১৮৭ পৃষ্ঠায় বলছেন, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতাবাদের একটি অপেক্ষাকৃত ভাল নাম দেওয়া হয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদ’। এই বোধটিই এখন দেশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিসত্তাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমরা সাম্প্রদায়িকতাবাদের ঐতিহাসিক কারণের কথা বলছিলাম। সেটি হচ্ছে শাসক আর শাসিতের মানসিক অবস্থান। নরমান ব্রাউন সোজাসুজি বলেছেন, “The Hindus cannot forget the thousand years from the Arab invasion in 711 to the end of the emperor Aurangzeb’s reign in 1707... “ সূত্র: দ্য ইউনাইটেড স্টেট এন্ড ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, (হার্ভার্ড, ১৯৭২) পৃষ্ঠা-১৩৫। এই হীনম্মন্যতা থেকে মনুবাদীরা আজও মুক্ত হতে পারল না। এম এন রায়, ‘দ্য হিস্টোরিকাল অফ ইসলাম’ নামক রোল গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “শত শত বৎসর ধরে দুটো সম্প্রদায় একই দেশে পাশাপাশি বাস করছে তবুও তারা পরস্পরের সংস্কৃতিকে বোঝবার খুব একটা চেষ্টাই না, এমন দৃষ্টান্ত আর একটাও নেই। পৃথিবীর কোন সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এমন অজ্ঞ নয়। কোনও সভ্য জাতিই হিন্দুদের মতো ইসলাম ধর্মের প্রতি এমন ঘৃণা পোষণ করে না।’’ তাদের এই মানসিকতা ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক বিচারের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীরদ সি. চৌধুরীও তাঁর আত্মজীবনীতে বাঙালি মুসলমানদের প্রতি বাঙালি হিন্দুর ঘৃণা আর বৈরিতার কথা উল্লেখ করেছেন। (উদ্ধৃতি, কামরুদ্দীন আহমদ, ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’, প্রথম খন্ড, (ঢাকা-১৩৮২), পৃষ্ঠা-৩৮-৩৯)। গত শতকের সাতের দশক থেকেই ভারতের সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িকতাবাদের চর্চা লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। দক্ষিণ ভারতের মীনাক্ষীপুরমে গণ ধর্মান্তর, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ভারতব্যাপী রথযাত্রা এবং ‘ভারতীয়করণ’ (হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান) বা ‘সংকৃত্যায়ন’-এর জোরদার পরিকল্পনা যখন শুরু হয় সেই সময় ‘মেজরিটি কমিউনালিজম’-এর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। প্রশাসনে ‘হিন্দু টিনজ’ অনুপ্রবেশ করে। বস্তুত আশির দশকে হিন্দুত্ববাদীরা সারা দেশের প্রশাসনে তাদের প্রভাব বিস্তার করে অবিশ্বাস্য তৎপরতা ও কৌশলে। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অংশ এর বিরুদ্ধে যথার্থ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অপারগ হয়েছে।
পশ্চিমবাংলাতেও এই প্রবণতা ক্রিয়াশীল হয়ে উঠলেও কমিউনিস্টরা এর বিরুদ্ধে গণসংগঠনের মারফত সেকুলার চিন্তাভাবনার প্রসারের জন্য কোন আন্দোলন করে নি। এমনতরো পরিস্থিতিতে আর.এস.এস. বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাকার সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিস্ময়াবহ সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় সামনে এনেছে। ১৯৯২-তে ‘ঐতিহাসিক ইন্দো-সারসেনিক’ স্থাপত্যের অন্যতম প্রতীক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গেরুয়া শিবিরের সগর্জন উপস্থিতি তামাম দুনিয়া নজর করেছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়ার মধ্যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল ছিল- ‘মুসলিম আইডেন্টিটি’কে ধ্বংস করা। এটি একটি বিশাল আন্তর্জাতিক জাতিসত্তার উপস্থিতিকে অস্বীকার করার সাম্প্রদায়িক হীন প্রবণতা। অর্থাৎ দেখ্-কেমন ‘দূরমুশ’ করেছি। ‘গুজরাট দাঙ্গা’ মুসলমানদের আর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকবর্গকে কম্পিত করে দিয়েছে। হালফিলের রাজধানী দিল্লির একপেশে গণহত্যা, লুটতরাজ, বাড়িঘর সম্পত্তি ধ্বংস, ধর্ষণ, নির্মমভাবে শিশু হত্যা; সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চারিত্র্যকেই ধ্বস্ত করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর মদতে এই দুষ্কর্মগুলো ঘটেই চলেছে। প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে কারারুদ্ধ করা হচ্ছে কিংবা-এনকাউন্টারের অছিলায় হত্যা করা হচ্ছে। ভারতের ইতিহাস সৃজন ও নির্মাণে ইসলাম এবং তার অনুসারী মুসলমানরা যে অমূল্য অবদান রেখেছে, তার যথার্থ মূল্যায়ন হলে গাণিতিক বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা উগ্র আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, প্রত্যয় হয় মুসলমানরাও হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct