পশ্চিমবঙ্গে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষাসহ কিছু নীতিতে পরিবর্তন এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এসব করতে গিয়ে মুসলমান ভোটাররা তাঁর ওপর কিছুটা ক্ষুব্ধ। নির্বাচনের মৌসুম শুরুর আগে রাজ্যে সংখ্যালঘু রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
কুম্ভ মেলার পাশাপাশি কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক হারে হিন্দু মন্দির গজিয়ে উঠেছে। কখনো তা স্থানীয় দেবতার নামে—যেমন শনি ঠাকুর, কখনো ধর্মীয়-ইতিহাসিক চরিত্রের নামে যেমন বাবা লোকনাথ, কখনো বাঙালি হিন্দুদের ঘরোয়া দেবতা শিব-কালী-লক্ষ্মী ইত্যাদির নামে। আবার কখনোবা সরাসরি উত্তর বা দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানি করা রামচন্দ্র, হনুমান (বজরংবলী), গণেশ বা সাঁই বাবার নামে। সে তুলনায় রাজ্যে নতুন মসজিদ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই রাজ্যে মোটামুটি ৩০ শতাংশ মুসলমান। স্বাভাবিকভাবেই এই নীতির প্রতিক্রিয়া হবে। কারণ, মানুষ ধরে নেবেন তৃণমূলের কাউন্সিলর, এমএলএদের সহযোগিতা ছাড়া এই ধরনের মন্দির স্থানীয় মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। এর পেছনে বিজেপি আছে কি না, সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ, সর্বত্রই তৃণমূলের রমরমা। মুসলমান সম্প্রদায়ের নারাজ হওয়ার এটাও একটা কারণ। এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল ভারতে এক দশকের বেশি ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার হাওয়া (অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি) বইতে শুরু করে। ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকেও এই হাওয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করছে খোদ আরএসএস। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একই হাওয়া বইছে। ফলে হিন্দু ও মুসলমান—দুই সম্প্রদায়ই তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে খেপে আছে। মুসলমানদের ক্ষোভ একটু বেশি। কারণ, মমতার নানা পদক্ষেপকে তাঁরা সম্পূর্ণ হিন্দুত্ববাদী বলে মনে করছেন। এই কারণেই হয়তো গত ফেব্রুয়ারিতে মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘিতে অনুষ্ঠিত বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন সংখ্যালঘু মসুলমানরা। সাগরদিঘিতে জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ মুসলমান। সেখানে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ প্রার্থী দিয়েছিলেন মমতা। তৃণমূল কংগ্রেসের এক সাবেক মুসলমান এমপির কথায়, দিদি হয়তো দেখাতে চেয়েছিলেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর প্রভাব কমেনি। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে হিন্দু প্রার্থী দিয়েও তিনি তাঁকে জিতিয়ে আনার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় তাঁকে ভুল প্রমাণ করেছেন।মমতা ভালো করেই বোঝেন, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান ভোটে ভাঙনের কী অর্থ হতে পারে। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের হেরে যাওয়ার যদি একটি মাত্র কারণ বলতে হয়, তাহলে বলতে হবে সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন। সাগরদিঘি ইঙ্গিত দিচ্ছে, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে ভাঙন শুরু হয়েছে।বসে নেই মমতা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বসে থাকার পাত্রী নন। সাগরদিঘিতে হারের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাঠে নেমে পড়েন। প্রথমেই তিনি হারের কারণ খতিয়ে দেখতে মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সরিয়ে দেন সংখ্যালঘুবিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রীকে এবং ওই দপ্তরে ফিরিয়ে আনেন তাঁর প্রিয় সচিব পি বি সেলিমকে। একটি সংখ্যালঘু উন্নয়ন বোর্ড গঠনের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের আলেম-ইমামদের দায়িত্ব দেন, মুসলমান সম্প্রদায় কেন তৃণমূল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে—সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাই প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সবশেষে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাসকে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয় তৃণমূল। বায়রন নিজেও অকপটে বলেন, ‘আমি তো বরাবর তৃণমূলই করতাম।’ তবে মমতা যতই পদক্ষেপ নেন বা তৎপরতা দেখান, তারপরও বাঙালি ও অবাঙালি দুই গোষ্ঠীর মুসলমানের অনেকেই ঘরোয়া কথাবার্তায় বলছেন, মধ্য বাংলায় অর্থাৎ মালদা ও মুর্শিদাবাদে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কংগ্রেস এখনো শক্তিশালী, সেখানে তাঁরা কংগ্রেসকে ভোট দেবেন। আরও কয়েকটি জেলায়ও তাঁরা কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন। এটা তৃণমূলের জন্য সুখের খবর নয়। হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গে মৃতপ্রায় কংগ্রেসের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা অংশের আস্থা বৃদ্ধির পেছনে একটা ব্যাখ্যা হলো কর্ণাটক নির্বাচনে তাদের বিরাট জয়। কংগ্রেসের এই জয় মমতাকেও যে কিছুটা চিন্তায় ফেলেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। গত মার্চে মমতা জোর দিয়ে বলেছিলেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কোনো দলের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে তৃণমূল একাই লড়বে। কিন্তু মে মাসে কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়ের পর তিনি বলেছেন, যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, সেখানে তাদের সমর্থন দিতে তৃণমূলের আপত্তি নেই। তবে ওদেরও আঞ্চলিক দলকে সমর্থন দেওয়া উচিত। অর্থাৎ কংগ্রেসসহ বিরোধী জোট থেকে গত মার্চে খানিকটা দূরে সরে গেলেও আবার কিছুটা কাছাকাছি ফেরার চেষ্টা করছেন মমতা। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে চাপ বাড়াচ্ছে, তাদের নেতা–নেত্রীদের নিয়মিত জেরা করা হচ্ছে। দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী রুজিরাকেও জেরা করছে ইডি-সিবিআই। অর্থাৎ সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের ওপরে চাপ শুরু হয়েছে। একদিকে প্রধান ভোটব্যাংক মুসলমানদের চাপ এবং অন্যদিকে কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থার লাগাতার জেরা—এই অবস্থায় আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে কী করবেন মমতা? একটু কি বিজেপির দিকে ঘেঁষবেন নাকি সরে যাবেন জোটের দিকে?এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওই সময় অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে ভারতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে নির্বাচন হবে। এই দুটি নির্বাচনে যদি কংগ্রেস হারে, তাহলে হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি হবে মধ্যপন্থা বজায় রাখা। যদি বিজেপি হারে, সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো অনেকটাই সরে যাবেন বিরোধী জোটের দিকে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ও নিঃসন্দেহে তাদের নির্বাচনী রাজনীতি স্থির করবে মুখমন্ত্রীর গতিবিধি দেখেই।
সমাপ্ত...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct