অভাবের নিত্য সংসারে এতটা কষ্ট আর চিন্তা হার মানাতে পারেনি।দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সময় গড়াতেই যতটা উদ্বেগ, উতকন্ঠা আর চাপা ভয় নিয়ে কেঁদে উঠেছে বৃদ্ধা শান্তি সর্দার। মঙ্গলবারের দুপুর,বিকেলের মনোপীড়া বুধবার সকালেও স্পষ্ট।চোখের কোন বেয়ে পিঁচুটি নেমেছে।উসকোখুসকো শরীরে স্বামীর সৎকারের কথা ভেবে ভেবে যে মনের মধ্যে দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।তার শরিক বৃদ্ধা শান্তি সর্দারের ছেলে দিন মজুর দুই ছেলে খোকন সর্দার ও স্বপ্ন সর্দার। তাদের বাবা আকালী সর্দার মঙ্গলবার দুপুরে বার্ধক্যজনিত কারনে মারা যাওয়ার পরেই ফাঁপরে পরে পরিবারটি।
নদিয়ার তেহট্ট থানার পলাশি পাড়ার ধাওড়া পাড়া গ্রামের সর্দার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।সৎকাজ করার সামর্থ ছিল না।খেই হারিয়ে ফেলে।দিশাহীন হয়ে পড়ে মৃত আকালী সর্দার (৮০)এর পরিবার। দুপুর যায়,তবুও সুরাহা মিল ছিল না।বিকাল আসার পরপরই হাত বাড়ায় পাড়ার মুসলিম প্রতিবেশীরা।
মাত্র ২১০ পরিবারে বসবাস গ্রামটিতে।তার অধিকাংশই মুসলিম পরিবার। ৭০ টি হিন্দু পরিবারের বসবাস বলে জানা গেছে।চাঁদা তোলার চেষ্টা করে সর্দার পরিবার।কিন্তু প্রতিবেশী ভাইয়ের যন্ত্রনার তীর মুসলিম ভাইদের বুকে এসে লাগে।একই সাথে বেড়ে ওঠা আকালী সর্দারের দাহ করার বেগ পাওয়া ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি।দেরি না করে এগিয়ে আসেন পাড়ার মুসলিম সম্প্রদায় মানুষ।
আকালী সর্দারের শেষ যাত্রা সুসম্পন্ন করতে আহ্বান জানানো হয মসজিদের মাইক থেকে। তারপর স্থানীয মুসলিমরা যে যার সাধ্য মতো সংগ্রহীত চাল ও টাকা নিয়ে পৌছায় আকালির বাড়িতে। এরপর সংগ্রহীত চাল ও টাকা নিয়ে মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ সম্মিলিতভাবে গ্রাম থেকে ছাব্বিশ কিমি দূরে কালীগঞ্জের রামনগর শ্মশানঘাটে নিয়ে যান।সেখানেই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ শ্মশানঘাটে উপস্থিত থেকে মৃত আকালী সর্দারকে রাতে দাহ করা হয়।
এদিনের সম্প্রীতির নজির গড়ে গোলাম হোসেন সেখ বলেন"আমি আর আকালী একই সাথে বড় হয়েছি।সে অভাবী ছিল।কাল মারা যাওয়ার পরে পরিবারটি কূলকিনারা পাচ্ছিল না।আমরা ওর প্রতিবেশী, ধর্ম নয় ও আমার প্রতিবেশী ভাই।আমরা না এগিয়ে আসলে কারা আসবে?"
মৃতের স্ত্রী শান্তি সর্দার জানান"ওরা আমাদের উদ্ধার করে দিল।বিপদে পড়েছিলাম।আমি, আমার দুই,ছেলে বউ সবাই চিন্তায় ছিল।এই ঋন ভুলব না।'
মৃত আকালী সর্দারের ছেলে খোকন সর্দারের মত"ঠিক মত দিনই চলে না।বাবা মরে যাওয়ার পরে ঘরে কিছু ছিল না।ওরা আমার জন্য অনেক কিছু করল।"
এই বিষয়ে তেহট্ট ২ ব্লকের বিডিও অভিজিৎ চৌধুরী জানান"প্রথমেই মুসলিম ভাইদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।ওরা সম্প্রীতির নজির গড়ল।সেই সাথে পরিবারটি যদি আমার কাছে আসে তাহলে দু,হাজার টাকা আর্থিক সহযোগীতা পাবেন।"
রাজ্য জুড়ে যখন এক শ্রেণীর মানুষ সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা করছে সেখানে একজন হিন্দু ব্যক্তির সতকারে মুসলিমদের এগিয়ে আসায় খুশি এলাকার মানুষ।"এটাই বাংলার সংস্কৃতি এটাই বাংলা বলে মত গ্রামের মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি জিয়ারুল সেখের।হিন্দু ভাইয়ের দাহ সম্পন্ন করতে মুসলিমদের ভূমিকা সর্দার পরিবারের চিন্তাকে সরিয়ে জানিয়ে দিল ধর্ম নয়।মানুষই শেষ কথা।প্রতিবেশী বৃদ্ধা শান্তি সর্দার,খোকন সর্দার,স্বপন সর্দারের চাপা ভয়ের আতঙ্কের পরিবেশে ভাগীদার প্রতিবেশী মানুষ।কুঁচকে যাওয়া কপাল নিয়ে চোখের কোন বেয়ে পিঁচুটি মুছতেই গড়িয়ে এলো দু,ফোঁটা অশ্রু। এই কান্না হতাশার নাকি গত দুপুরের সেই সাক্ষী মনের চোরাস্রোত বোঝা গেল না।তবে জয় হল সবার উপরে বড় মানুষের ধর্ম।মানবিক ধর্ম।সেই কথায় হয়ত ভেবে চলেছে বৃদ্ধা শান্তি সর্দার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct