বর্তমান ভারতে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ব্যাপক উত্থান। বস্তুত রাষ্ট্রিক আর সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক আচরণ লালিত-পালিত এবং উৎসাহিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীর দ্বারাই। ভয়ের কারণ, ফ্যাসিবাদের পোষক সরকার সাম্প্রদায়িকতাবাদের বীভৎস প্রকাশ সাম্প্রদায়িক একতরফা দাঙ্গার মারফত দেশস্থ বিশেষধর্মী মানুষজনের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তা নিয়ে এই সন্দর্ভ পত্রটি লিখেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
ঔপনিবেশিক শাসন-শেষে রাজনৈতিক অনৈক্য দূর করে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা সফল হয়নি, একথা ইতিহাস সত্য। কিন্তু ভারতের জীবন সাধনার মধ্যে ধ্বংসাত্মক অনৈক্য-ও প্রাধান্য পায়নি। ভারতবর্ষের মধ্যে এমন এক জীবনধারা প্রবাহমান যা এদেশের ঐক্য ভাবনাকে ব্যাহত হতে দেয় না।রবীন্দ্রনাথ বলছেন, প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা ভারতবর্ষের চিরদিনের একমাত্র প্রচেষ্টা। তাই জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্ম-সংস্কৃতিগত বিভিন্নতা এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও ভারতীয়দের মধ্যে এক বিশেষ মাত্রার ঐক্য দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠেছে। ভিন্সেন্ট আর্থার স্মিথ বলছেন, ভারত নিঃসন্দেহে এক গভীর মৌলিক ঐক্য ধারণ করে। বস্তুত ভারত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। পণ্ডিত-দার্শনিক অধ্যাপক হুমায়ুন কবিরের মন্তব্য, ভারতীয় সংস্কৃতি হল ঐক্য সমন্বয়, বোঝাপড়া, প্রগতির কাহিনি, পুরনো ও নতুন ঐতিহ্যের নিখুঁত সংমিশ্রণ। এতদ্বিষয়ে আলফ্রেড রিজলি বিশ্লেষণ শেষে বলছেন, প্রাকৃতিক, সামাজিক, ভাষাগত, রীতিনীতি ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের অন্তরালে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে এক অখন্ড জীবনপ্রবাহ চলছে। বিবেকানন্দও ভারতের অখন্ড রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সাময়িক দ্বিধাদন্দ্ব, সংঘর্ষ, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনাকে-দীর্ণ-বিঘ্নিত করেছে, একথা সত্য, কিন্তু ভারতের যা কিছু বৈচিত্র্য তা একান্ত বাহ্যিক ও দৈহিক। ঐক্যই ভারতের ইতিহাসের অনন্যতা। নানান রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও সেই শাশ্বতবোধ অমলিন থেকেছে। হাল আমলে ভারতের বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যকে আমরা সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি, সেটিও সবিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রখরভাবে উজ্জীবিত করার জন্য বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী যে অতিশয় তৎপর, তা উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় না। এমন দমবন্ধ করা ‘গরম হাওয়া’-বিবেকবানদের বিচলিত করে তুলেছে। স্বদেশের শিক্ষিত প্রগতিশীল অংশের বিশিষ্টজনেরা এই অস্বস্তিকর জীবনযাপনের মধ্যে সন্তুষ্টির কোন উপাদান খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রতিনিয়ত মানব-আত্মার এমনবিধ অবমাননা ক্লিষ্ট করে তুলছে। এক ‘অদ্ভুত আঁধার’ চারিদিক গ্রাস করেছে। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব নিশ্চয়ই ‘সময়’ বের করে আনবে। ইতিহাস তেমনই তো বলে! উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সরকার ‘Islamo-Phobia’-য় ভুগছে। এর ফলে বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি ক্রমেই নিষ্প্রভ আর মলিন হয়ে পড়ছে। সহিঞ্চুতা ও সভ্যতার ধারণাকে স্বচ্ছ করার জন্য ভারত সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট মনে হচ্ছে না, তাবৎ দুনিয়ার সভ্য-ভব্য মানুষের কাছে। শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের উপরেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর ধর্মভিত্তিক-সাম্প্রদায়িক দমন-পীড়ন হচ্ছে তাই নয়। ভারতে শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের রাষ্ট্রীয় দখলদারি আর আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক অপ-প্রয়াস লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠছে।
বিষয়টি কিঞ্চিৎ আলোচনার মধ্যে নিয়ে আসা হল:
মানব সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর খবরদারি শুরু করেছে ‘মোদী জামানা’র শুরু থেকেই। ২০১৫-তেই শ্রী হরি গৌতম নামক এক ভদ্রলোককে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক একটি কমিটির কর্তার-কুর্শিতে বসিয়ে দিয়েছিল। কে এই হরি গৌতম! খোলসা করা যাক। পূর্ববর্তী এনডিএ সরকারের আমলে এই মানুষটি ‘ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন’-এর ‘চেয়ারপার্সন’ ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি ‘এত্তেলা’ দিয়েছিলেন যে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘বৈদিক অঙ্ক’কে বিজ্ঞান বিষয়ক শাস্ত্র হিসেবে পঠন-পাঠনের এক্তিয়ারে নিয়ে আসতে হবে। এমন নির্দেশে যথার্থ বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্বৎসমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ‘সেন্টার ফর সেলুলার এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি’র প্রাক্তন পরিচালক পি.এম ভার্গব, মোকদ্দমা পর্যন্ত করেন। আখেরে অন্ধ্রপ্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রকে পাঠ্যসূচির তালিকায় ঠাঁই দেয়। এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক পাঠ্যসূচির কারণে যুক্তিবাদীরা উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থায় গৈরিকীকরণের কারসাজি দেখতে পাচ্ছেন। এবার ভিন্নতর একজন স্বঘোষিত পণ্ডিত প্রবরের কথা বলি। তিনি দীননাথ বাত্রা। প্রবীণ এই মানুষটি একদা ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’-এর স্কুলে পড়াতেন। এতদ্দেশীয় সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শের উপর ভিত্তি করে বিস্তর বইপত্র লিখেছেন। গুজরাট সরকার রাজ্যের ৪২,০০০ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল লাইব্রেরিতে তাঁর লেখা নানান ইতিহাস বই রাখার ফরমান জারি করেছে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও কথিত বিজ্ঞানচর্চার ওপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা ‘তেজময় ভারত’এ সনাতন আদর্শের যশোগান করা হয়েছে অবলীলায়। যুক্তি-তর্কের কোনো তোয়াক্কা করেননি। তাঁর বিশ্বাস, জন্মের সুবাদে কেউ যদি ‘হিন্দু’ না হন তাহলে তাঁর পক্ষে এই সভ্যতার মর্মার্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সেই কারণে তিনি ‘বারানসী সেক্রেড লাইট’ নামক বইটির বিক্রির বন্ধের সমন জারি করেন। বইটির লেখিকা, ডায়ানা জন্মসূত্রে খ্রিস্টান। একই কারণে ওয়েল্ডি ডনিগার-এর ‘দ্যা হিন্দুজ : অ্যান অল্টারনেট হিস্ট্রি’-র সব কপি ধ্বংস করে দেবার পক্ষে তিনি সওয়াল করেন। দীননাথ বাত্রা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নানাবিধ উপকথাগুলোর প্রতি অনিঃশ্বেষ গুরুত্ব আর মর্যাদা আরোপ করেছেন। উদাহরণ দেওয়া যাক: ‘ঋষি-মুনিরা আদি বৈজ্ঞানিক, পুষ্পক রথ হল এরোপ্লেন, ব্রহ্মাস্ত্র হল এ্যাটমবোম, গান্ধারীর গর্ভজাত মাংসপিণ্ড থেকে একশত সন্তানের জন্ম-‘স্টেম সেল’-রিসার্চের ফসল, ইত্যাকার বিষয়। বস্তুত তিনি তিনটি মিথের উদ্ভাবক।
১. প্রাচীন ভারতে সর্বোচ্চ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। এটি ‘স্বর্ণযুগ’। মধ্যযুগ হল, ‘‘সার্বিক অধঃপতনের এবং নিরবচ্ছিন্ন পরাধীনতার যুগ’’।
২. মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ দেশের প্রাচীন যুগ অতুলনীয়। বিজ্ঞানের উন্নতি এমন ছিল যে বিমান এবং পরমাণু বোমা তাঁদের অজ্ঞাত ছিল না। রাজনীতি-সমাজনীতি আধ্যাত্মিক তথা আত্মিক শক্তির জগতে ভারতবর্ষ উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল।
৩. খাঁটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ হল বৈদিক যুগের আর্য সমাজ ও সংস্কৃতি। অর্থাৎ তিনি অনার্য তথা দ্রাবিড় সভ্যতাকে অস্বীকার করতে চান। ওই সমস্ত মিথগুলো রাজশেখর বসু থেকে মেঘনাদ সাহা বহু আগেই নস্যাৎ করে দিয়েছেন। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রামায়ণ আর মহাভারতকে মহাকাব্য হিসেবে অতুল্য বিবেচনা করতেন, ইতিহাস হিসেবে নয়। রামশরণ শর্মা, রোমিলা থাপার আর ইরফান হাবিবের প্রসঙ্গ নাইবা তুললাম। এই উপ-কথা-নির্ভরতার ফলে সমাজের দুর্বলতা; দীননাথ বার্তরারা স্বীকার করতে আগ্রহী নন।এই উপকথাগুলো বহুজাতিক ভারতের সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টিতে বারুদের মতো কাজ করে। কেননা এতে অন্যান্য জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করে; অধিকার করার প্রবণতা পুরোমাত্রায় থেকে যায়। বিপনচন্দ্র বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ইতিহাসের অপব্যবহার সংশোধনের জন্যে আন্তরিক চেষ্টা করতে গেলে আমাদের এইসব উপকথাগুলিকেও ধ্বংস করতে হবে।’এমন দুর্যোগের মধ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ভারতের ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়ন; সেক্যুলার এ্যান্ড সাইন্টিফিক চর্চা শুরু করেছেন। এইসব আধুনিক বস্তুবাদী মূল্যায়নগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়া একান্ত জরুরি। তাহলেই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। বিবেচ্য বিষয় এই যে, সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের দ্বারা লিখিত ইতিহাস একটা জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সর্বোপরি রাষ্ট্রপরিচালন পদ্ধতিতেও সেক্যুলারিজমের চর্চা জরুরি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct