আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে মণিপুর এখন বিশ্ব সংবাদ। সেখানে সহিংসতায় ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ জন মারা গেল। ঘটনা শুরুর ২৬ দিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইম্ফলে গেলেন। তিন দিন থাকলেন সেখানে। এই সহিংসতার কারণ ও ফলাফল নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর লেখা হচ্ছে। রাজ্যের রাজধানী ছাড়াও অমিত শাহ যে মোড়ে নামের একটা শহরেও গেলেন, সেটাই সহিংসতার পূর্বাপর বুঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে। লিখেছেন আলতাফ পারভেজ। আজ শেষ কিস্তি।
এথনো-পলিটিকসের জটিল গিট্টু
নয়াদিল্লির ‘পূর্বে চলো’ নীতির সাবলীল অগ্রগতির জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সব রাজ্যে স্থিতিশীলতা দরকার। বিশেষভাবে প্রয়োজন মণিপুরকে শান্ত রাখা, যেহেতু এখান দিয়ে গেছে এশিয়ান হাইওয়ের প্রধান অংশ। চলতি সহিংসতায় স্পষ্ট, এত দিন পুরো উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে নয়াদিল্লি যেভাবে ‘শান্ত’ রেখেছে, তার পেছনে টেকসই সমাধান ছিল না। মইতইদের প্রতি মণিপুরের জো জাতিগুলোর ক্ষোভের আঁচ মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডেও লাগবে। কারণ, তারাও বৃহত্তর জো জাতি। আবার সীমান্তের উল্টো দিকে মিয়ানমারের চিন ও সাগাইনেও রয়েছে জো’রা। এ কারণে মণিপুরের অশান্তি পুরো এশিয়ান হাইওয়ে রুটকে ঝুঁকিতে ফেলবে। মইতইদের প্রতি কুকি-নাগাদের ক্ষোভ এক অর্থে এসব এলাকার পাহাড়ি জাতিসত্তাগুলোর স্বাধিকার বোধের এক সহিংস প্রকাশ। এটা হঠাৎ সৃষ্ট সহিংসতা নয়। এখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে স্থানীয় জনজাতিগুলোর রয়েছে গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ। কয়েক বছর আগে মোড়ে দিয়ে ৪০টি পণ্য বেচাবিক্রির একটা চুক্তি করে নয়াদিল্লি ও নেপিডো। কৌতুককর ব্যাপার হলো, স্থানীয় মানুষ কেউ জানে না কী কী পণ্যের নাম আছে এই তালিকায়। অথচ ব্যবসা করছে তারাই। বোঝা যাচ্ছে, নয়াদিল্লি থেকে মোড়ের দূরত্ব ভৌগোলিকভাবে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার হলেও প্রশাসনিকভাবে আরও বেশি। ফলে, একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৭২ ঘণ্টায় সবকিছু শীতল হবে না। তারপরও অমিত শাহ তিন দিনে অন্তত দুই ডজন বৈঠক করেছেন। নয়াদিল্লির নানান উদ্যোগ ইম্ফলের মতো শহরকে আপাত শান্ত রাখলেও মোড়ের মতো সীমান্ত শহরগুলো নানানভাবে সশস্ত্র গেরিলা দলগুলোই চালাতে থাকবে। মোড়েকে এত দিন ভারতীয় প্রচারমাধ্যম উন্নয়নের দৃষ্টিনন্দন প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছিল। শুল্ক বিভাগ, পর্যটন বিভাগসহ নানান দপ্তরের একের পর এক ভবন আর বাণিজ্যিক তৎপরতায় মোড়ে হয়ে উঠছিল ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির জীবন্ত এক প্রাপ্তি। কিন্তু সমাজের গভীরে রয়ে গিয়েছিল সমাধানের অপেক্ষায় থাকা এথনো-পলিটিকসের ঐতিহাসিক নানান গিট্টু। বাড়িঘর, চার্চ, মন্দির পুড়ে সেটাই আবার জানাজানি হলো।
মোড়ের মতো শহরগুলোয় শান্তি আসবে কীভাবে
মইতই, কুকি ও নাগা গেরিলাদের বেশ নজরকাড়া উপস্থিতি আছে মোড়েতে। রাষ্ট্রীয় চেকপয়েন্টগুলোর চেয়ে তাদের অদৃশ্য চেকপয়েন্ট বেশি। ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ নামে সাগাইন ও মোড়ের মাঝের অনেকখানি জায়গায় এরা রীতিমতো দল বেঁধে থাকে। তাদের কর আদায়ের ব্যবস্থাও শক্তিশালী। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর চুরাচান্দপুরে পিএলএ নামের স্থানীয় গেরিলা দলের অ্যামবুশে পড়ে একজন কর্নেলসহ আসাম রাইফেলসের পাঁচ জওয়ান খুন হলো। প্রান্তিক এসব জনপদে কর্মসংস্থানের উপায় কম। এ কারণে তরুণদের সামনে গেরিলাজীবনের আহ্বান থাকে। কুকি ছাড়াও এই অঞ্চলে নাগা এনএসসিএনের (ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড) ব্যাপক সশস্ত্র প্রভাব আছে। নাগারা তাদের মূল এলাকার বাইরেও মণিপুরসহ আশপাশের রাজ্যের নাগা গ্রামগুলো নিয়ে ‘নাগালিম’ নামে স্বতন্ত্র আবাসভূমি চায়। ইম্ফলের চারদিকের পাহাড়ি এলাকাগুলোও তারা নিজেদের দাবি করে। এখন এই একই অঞ্চলে কুকিরা চাইছে মণিপুর ভেঙে আলাদা রাজ্য। শেষ পর্যন্ত হয়তো মণিপুরের এই পাহাড়ি এলাকাগুলো নাগাদের খুশি করতে ভবিষ্যতের নাগালিমে জুড়ে দেওয়া হবে। ইম্ফলের মইতইরা এতে হারাবে তাদের পুরোনো ইতিহাস-ঐতিহ্যের রাজ্যটি। আবার এমনও হতে পারে, নাগাদের যাতে এসব এলাকা না দিতে হয়, সে জন্য কুকিদের হাতে ইম্ফলের চারদিকটা পৃথক রাজ্য বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে পাহাড়ি জনপদগুলোয় এ রকম ভৌগোলিক ভাঙাভাঙির নজির বিপুল। প্রশ্ন হলো, এ রকম ভাঙাভাঙির মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সন্নিহিত জনপদের জাতিসত্তাগুলো কি আন্তদেশীয় উন্নয়নধারায় আদৌ মতামত দেওয়ার সুযোগ পাবে? তাদের অংশীদারত্ব কতটা থাকছে এসব উদ্যোগে? মণিপুরের সহিংসতা আবারও পুরোনো এসব প্রশ্নই সামনে আনছে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট’-এর অংশ হিসেবেই মোদির শাসনামলে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় সাতটা নতুন বিমানবন্দর হলো। ২০১৪ থেকে এর সব রাজ্যে প্রায় ২২ হাজার রুপির ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। এসব উন্নয়নের সুবিধাভোগী কারা—মণিপুর সহিংসতার পর সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। এসব উন্নয়ন কি স্থানীয় মানুষের স্বার্থে হয়?বাস্তবতা হলো, মোড়ের মানুষ নয়াদিল্লির ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির সামান্যই জানে—সামান্যই বোঝে। ‘অদ্ভুত ধাঁচ’-এর এসব বিষয় কেবল টেলিভিশনে শোনে তারা। এখানকার মানুষ শান্ত ও সজীব থাকার জন্য চায় কেবল স্বশাসন। সেটা নেই বলেই ‘আর্মস ফোর্সেস অ্যাক্ট’-এর মতো দানবীয় আইন কার্যকর থাকার পরও সহিংসতা রোখা যায়নি। গত এক মাসের সহিংসতায় মণিপুরে বিভিন্ন বাহিনীর কাছ থেকে কেবল অস্ত্র লুট হয়েছে প্রায় এক হাজার।
(সমাপ্ত)
সৌ: প্র: আ:
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct