জঙ্গল রহস্য
তাপস কুমার বর
প্রিয়তোষ জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। কিন্তু এই জঙ্গল গভীর নিশুতি রাতে হয়ে ওঠে “রক্ত পিপাসু দানব”। প্রিয়তোষ কয়েকদিন আগে ডিটেকটিভ ও জ্যোতিষ বিজ্ঞানের কয়েকটা বই কলেজস্ট্রিট থেকে সংগ্রহ করে এনেছে। সে চায় এই জঙ্গলের রহস্য ভেদ করতে। দিন-রাত সে নানান চিন্তা নিয়ে ভাবে,.....“কি আছে এই জঙ্গলে? আজও মানুষ কেন আতঙ্কিত? এর রহস্য ভেদ করতে হবে!”- কয়েকদিন আগে প্রিয়তোষ খবর কাগজের সংবাদ শিরোনামে পড়েছে, দিনে দিনে “চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। তবে চোরেদের উপযুক্ত স্থান হলো, যেখানে মানুষের আগমন কম, সেই জায়গা তাদের জন্য উপযুক্ত। প্রিয়তোষের বন্ধু রিপন পেশায় একজন সংবাদ কর্মী। প্রিয়তোষ পেশায় একজন শিক্ষক। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় রিপনের সঙ্গে দেখা। হঠাৎ দুজনে কথোপকথন শুরু করলো-রিপন- প্রিয়তোষ না কি? প্রিয়তোষ- বন্ধু রিপন। অনেক দিন পর আবার দুজনের দেখা।রিপন- জানিস, প্রিয়তোষ! তোদের বাড়ির পাঁচ কিলোমিটার দূরে ওই জঙ্গলের রহস্য নিয়ে নানান তথ্য উঠে আসছে। কিন্তু কেউ সাহজ করে যেতে চাইছে না। তাদের মুখে শুনছি,.....“জেনে বুঝে মৃত্যুকে ডাকা”প্রিয়তোষ- কিছুক্ষণ চুপ! তারপর বলতে শুরু করলো। এই বিষয় নিয়ে আমি ও বেশ কিছু দিন চিন্তিত। তবে এর রহস্য ভেদ করতে গেলে “ওই জঙ্গলে প্রবেশ করতে হবে”!রিপন- এই কথা শুনে, প্রিয়তোষ কে বললো, এটা আমি ও চাই এর একটা সমাধান হোক। তবে বন্ধু কোন সহযোগিতা লাগলে তোর পাশে তোর এই বন্ধু আছে সবসময়।প্রিয়তোষ- বললো, জানি বন্ধু। অবশ্যই তোর সহযোগিতা লাগবে। চল সামনে ভোলাদার চা দোকান। ওখানে প্রিয়তোষ রিপনকে নিয়ে গেলো। দুজনে চায়ের কাপে চুমু দিয়ে সেই ছেলেবেলার স্মৃতিতে হারিয়ে গেলো দু’জনে। বাড়ি ফেরার পথে দু’জনে হাত নাড়িয়ে প্রিয়তোষ বললো,....“বন্ধু একদিন তোর ডাক পড়বে, সেদিন সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে আসিস। আর কিছুটা দিন আমার সময় লাগবে রিপন। দু’জনে বাড়ি ফেরার পথে রওনা দিলো। ছেলেবেলা থেকে প্রিয়তোষ ডিকেটটিভ বইয়ের প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট কারণ এর মধ্যে আছে নানান রহস্য। তাইতো সে শার্লোক হোমস, ব্যোমকেশ, ফেলুদা বই-এর মধ্যে একটা রহস্য খুঁজছে। আর কিছু দিনের মধ্যে বর্ষাকাল পড়ে যাচ্ছে। সামনের রবিবার প্রিয়তোষ রিপনদের বাড়িতে গেলো। বন্ধু রিপন প্রিয়তোষকে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি। প্রিয়তোষ বললো, জানিস রিপন ,...“জঙ্গলের রহস্য আমার মাথা থেকে সরছেনা। তাই আমরা এই সামনের পূর্ণিমাতে পাঁচজন মিলে রহস্য অভিযানে বেরোব। রিপন- সবকিছু ঠিক ঠাক আছে তো প্রিয়তোষ?প্রিয়তোষ- সবকিছু ঠিক ঠাক আছে বন্ধু। তবে আমরা যে এই অভিযানে বেরোব কেউ যেন জানতে না পারে। তাহলে শত্রু পালাতে পারে।রিপন- তোর কি মনে হয়, ওখানে ভূত আছে? প্রিয়তোষ- তবে সঠিক ভাবে আমি এখন বলতে পারছিনা। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগছে।রিপন- তোর এমন কেন মনে হচ্ছে?প্রিয়তোষ - সব জানতে পারবি। তবে তার আগে, একটা টর্চ লাইট, দুটো মোমবাতি, দুটো পিস্তল আর সঙ্গে রমেন ও শুভকে সঙ্গে নিয়ে নিস। মনে যেন থাকে এই সামনের পূর্ণিমাতে।রিপন- আমরা তো চারজন হচ্ছি তাহলে।প্রিয়তোষ- আমি, থানার বড়ো বাবুকে বলে রেখেছি উনিও রাজি হয়েছে যাওয়ার জন্য। রিপন- তাহলে কিছুটা সাহজ পাওয়া গেলো বল।প্রিয়তোষ- তবে খুব সচেতন থাকতে হবে। একটা কথা মনে রাখিস “সামনের শত্রু কিন্তু খুব শক্তিশালী। যদি আমার বিশ্লেষণ সত্য হয়। তাহলে প্রতি পদে পদে বিপদ থাকতে পারে। রিপন- তোর প্রতি বিশ্বাস আছে বন্ধু। স্কুলের সেই সেরা ছেলেটি, যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, সে হচ্ছে “আমার প্রিয়তোষ”!
প্রিয়তোষ- তাহলে এখন উঠি বন্ধু। সব ঠিক-ঠাক থাকলে সংবাদ শিরোনামে এটাই সবচেয়ে বড়ো খবর হবে।রিপন- হ্যাঁ বন্ধু।প্রিয়তোষ চলে গেলো, আর মাত্র একটা দিন। চিন্তা প্রিয়তোষকে গভীর ভাবে চেপে বসেছে। হঠাৎ,.... “জঙ্গলের রহস্য ভেদে পাঁচজন, সামনে একটা রক্ত পিপাসু দানব, চোখে ফসফরাসের আগুন। সামনের দিকে এগিয়ে আসছে”।- প্রিয়তোষের ঘুমটা ভেঙে গেলো। সে রহস্য ভেদ করে ছাড়বে। পরদিন সকালে থানার বড়োবাবু প্রিয়তোষকে ফোন করে বললো, প্রিয়তোষ সব ঠিকঠাক আছে তো। হ্যাঁ স্যার সব ঠিকঠাক আছে সন্ধ্যা ছয়টায় আমার বাড়িতে চলে আসুন। এখান থেকে সকলে একসঙ্গে বেরোব। স্যার অনেক কষ্টে একটা গাড়ি ঠিক করেছি তবে একটু বেশি বকশিশ দিতে হচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভার এক কিলোমিটার আগে আমাদের রাস্তার নামিয়ে দেবে। তাই এক কিলোমিটার হাঁটতে হবে স্যার।সঙ্গে পিস্তল ও নিয়ে আসবেন। কারণ বিপদ কখন কি হয় বলা যায়না! সামনে একটা অস্ত্র থাকলে কিছুটা মোকাবিলা করা যায়। বড়োবাবু বললো, সঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো তোমার বাড়ি। এই বলে ফোনটা রেখেদিল। সন্ধ্যা ছয়টার অনেক আগে রিপন, রমেন ও শুভ পৌঁছে গেছে কিন্তু এখনো থানার বড়ো বাবু আসছেনা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বড়োবাবু হাজির হলো। সকলকে বললো, রাস্তা জ্যামের জন্য কিছুটা দেরি হয়ে গেলো। তাহলে আর দেরি নয়, এবার বেরিয়ে পড়া যাক। প্রিয়তোষ সকলের মুখের দিকে তাকালো,.....“সকলের মনে একটা কৌতুহল! কি আছে ওখানে ভূত না অন্যকিছু?”- গাড়িতে বসে পড়লো সকলে। গাড়ির ড্রাইভার দূত গতিতে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। সকলে নীরব। প্রিয়তোষ বললো,....“সবদিক দিয়ে নিজেদের সচেতন রাখতে হবে, কেউ যেন হাতছাড়া না হয়।”- বড়োবাবু সকলের মনে একটা সাহজ জোগানোর জন্য কয়েকটা জোকস শোনালো। সকলে তার জোকস শুনে হো-হো করে হেসে উঠলো। কিছুক্ষণ পর গাড়ির ড্রাইভার বললো,...“বাবু আর যেতে পারবো না, এখানে নেমে যেতে হবে সকলকে। অগত্যা কথা অনুসারে সকলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। প্রিয়তোষ ড্রাইভারকে হাতে বকশিশ গুঁজে দিতেই। তিনি গাড়ি নিয়ে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্রুত গতিতে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রিয়তোষ সকলের সামনে এগিয়ে চলছে। গুটি গুটি পায়ে এক এক করে চারজন জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। বন্ধু রিপন, রমেন, শুভ ও থানার বড়োবাবু। রাস্তার চারিদিকে ঝাউ ও তাল গাছের সারি। সকলে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে প্রবেশ করতে থাকলো। এদিকে আজ পূর্ণিমা রাত। চাঁদ তার সৌন্দর্য নিয়ে “একটা রহস্য ভেদি ছলনাময়ীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে”। হঠাৎ জঙ্গলে শিয়ালের কোরাস ও প্যাঁচার ডাক একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশের বার্তা দিয়ে গেলো। রমেন প্রিয়তোষকে চেপে ধরলো। প্রিয়তোষ বললো, ভয়ের কোন কারন নেই এটা শেয়াল ও প্যাঁচার ডাক। সকলে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করছে। তবে প্রিয়তোষ বললো, জঙ্গলে বিষাক্ত সাপ, পোকা-মাকড় আছে। সকলে সাবধানে এগোবে। প্রিয়তোষ ও সঙ্গে একটা পিস্তল নিয়ে এসেছে। জঙ্গলে হঠাৎ যেন একটা নৃত্য শুরু হয়েছে। পশু-পাখি,হিংস্র জীবজন্তুর ডাক সব একসঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একটা ভঙ্কর পরিবেশ গড়ে উঠেছে এই জঙ্গলে। বর্ষার দিনেও সকলের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। এই জঙ্গলের কিছুটা দূরে একটা বহুবছরের পুরানো বটগাছ আছে। ওখানে আছে একটা পোড়ো ভাঙা মন্দির। বহু বছর আগের এই মন্দির না কি খুবই জাগ্রত ছিল, আজ এই মন্দির না কি অভিসপ্ত। হঠাৎ শুভ বললো,....
“পেছন দিয়ে কে চলে গেলো না?”- থানার বড়ো বাবু বললো, কোথায়? শুকনো পাতার আওয়াজ। শুভ আর কিছু বললো না। রিপন টর্চের আলোটা এদিক সেদিক ফেলছিল। হঠাৎ বটগাছের দিকে আলোটা পড়তেই। অস্পষ্টের মতো সকলে কিছু একটা জিনিস দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তোষ ও বড়োবাবু বন্দুক উচিয়ে বটগাছের দিকে দৌড়াতে লাগলো। হঠাৎ বড়োবাবুর বন্দুক থেকে গুলির আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে গাছে বসা কয়েকটা প্যাঁচা চিৎকার করতে করতে উড়ে চলে গেলো। রিপন হাঁপাতে হাঁপাতে বড়োবাবু কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলো? কিছু পেলেন স্যার! প্রিয়তোষ চুপ! ওই সামনে ওটা কি? সকলে বিস্মিত! পা এগোচ্ছেনা। পোড়ো মন্দিরের সামনের বটগাছে ঝুলছে একটা মৃত কঙ্কাল। রীতিমতো শুভ ও রমেন ভয় পেয়ে গেছে। তারা বলছে,.....“ফিরে চলুন আর এখানে নয়। ওরা কাউকে বাঁচতে দেবেনা”!- প্রিয়তোষ দু’জনকে ধমক দিলো। রীতিমতো দু’জনে চুপ। মন্দিরের পেছন দিয়ে একজন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো। থানার বড়োবাবু চিৎকার করে বলছে,....“থাম ওখানে, পালানোর চেষ্টা করলে গুলি খেয়ে মরতে হবে”।- লোকটি পালানোর চেষ্টা করলো। সঙ্গে সঙ্গে থানার বড়োবাবু রিপনের হাত থেকে টর্চের লাইটা কেড়ে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড় মারলো। কিছুক্ষণ পর একটা গুলির আওয়াজ। এদিকে প্রিয়তোষ,শুভ ও রমেন তিন’জনকে পাকড়াও করেছে। রিপন সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলো বড়োবাবুর দিকে। কিছুটা দূরে একজন পায়ে বন্দুকের আঘাত পেয়ে যন্ত্রণায় ছটপট করতে লাগলো। প্রিয়তোষ সঙ্গে রমেন ও শুভ এই তিনজন মিলে, তিনটে চোরকে পাকড়াও করে আনলো। বড়োবাবুকে প্রিয়তোষ বললো,.....“এতোদিন তাহলে ভূতের রাজত্ব চলছিল কি বলেন বড়োবাবু”?- সঙ্গে সঙ্গে বড়োবাবু থানায় খবর জানায়। ঘন্টা দু’য়েক পর। গাড়ি পৌঁছায়। সকলকে গাড়িতে উঠিয়ে। থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে, থানার সামনে মিডিয়ার ভিড়। এতোদিনে তাহলে একটা রহস্য উদঘাটন হলো। থানার বড়োবাবু ও প্রিয়তোষ দু’জনে থানায় চারজন চোরাকারবারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে,....“তারা বহুবছর থেকে এই জঙ্গলে চোরাকারবারী করছে। মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য কাটা লাশ নিয়ে এসে এই বটগাছে ঝুলিয়ে রাখতে। একদিন কয়েকজন গ্রামবাসী তাদের কু-কীর্তি জানতে পেরে গিয়েছিল। তাদের এই জঙ্গলে মেরে মন্দিরের পেছনে পুঁতে রেখেছিল। সেই থেকে গ্রামে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। জঙ্গলে ভূত আছে। তারপর থেকে এই জঙ্গলে তেমন একটা কেউ আসতো না। এর ফলে তাদের কার্য সফল হয়। রমরমিয়ে চোরাকারবার চলছিল।”- বড়োবাবু বললো, প্রিয়তোষ আজ উপর মোহল থেকে আমার প্রোমোশনের নোটিশ এসেছে। প্রিয়তোষ একটু মুচকি হাসলো। বড়োবাবু বললো, সব তোর জন্য হয়েছে। প্রিয়তোষ ও বলতে শুরু করলো, “না স্যার আপনার সাহজ ও নিষ্ঠা, এটাই তার ফল”!- রিপন প্রিয়তোষকে জড়িয়ে ধরে বললো,..”আজ আমার সংবাদ পত্রে এই শিরোনাম তোলপাড় করে দিয়েছে প্রিয়তোষ”।বহু বছরের রহস্য উদঘাটন হলো বল। একদম ঠিক বলেছিস বন্ধু। তবে তুই আমাকে বল,কি করে তুই এই রহস্য জানতে পারলি? প্রিয়তোষ বললো, প্রতিটা সংবাদ পত্রে চোরাকারবারীর দৌরাত্ম্য বাড়ছে,এই খবর বারবার ধরে প্রকাশ পাচ্ছে সংবাদ শিরোনামে।কিন্তু আমি এর সূত্র পাচ্ছিলাম না। স্থির মস্তিষ্কে কিছুদিন ভাবলাম। তখন মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল,.....“চোরেরা সবসময় গোপন থাকতে চায়। তাদের সেই সব জায়গা পছন্দ সেখানে মানুষের আগমন কম”!- বাহ্ বন্ধু! তোর বুদ্ধির তারিফ করতে হয় বই কি? না না এমন বলিস না এই জয় সকলের। বড়োবাবু, রমেন, শুভ ও তুই সকলে ছিলাম বলেই এই রহস্য উদঘাটন হলো। রিপন বললো,.....“সেই বুদ্ধিমত্তা, চতুর, দক্ষ ন্যায়;নিষ্ঠাবান আমার প্রিয়তোষ”!- এই কথাগুলো শুনতে শুনতে প্রিয়তোষ, চোখে চশমা লাগিয়ে রিপনের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct