শ্রদ্ধায় স্মরণে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ
এম ওয়াহেদুর রহমান
উনিশ শতকের শেষার্ধের ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মুসলিম বাংলা তথা মুসলিম ভারতের গণজাগরণের পথিকৃৎ এবং যুগস্রষ্টা ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। তিনি ১৮৬৬ সালের ৭ জুন অবিভক্ত পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্ৰামে জন্মগ্ৰহন করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব গাজী মাওলানা আব্দুল বারী খাঁ ও মাতা বেগম রাবেয়া খাতুন। তাঁর পিতামহ তোরাব আলী খাঁ সৈয়দ হাজী নিসার আলী তিতুমীরের সহযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতা - মাতাকে একই সঙ্গে হারান। প্রসঙ্গত আব্দুল বারী খাঁ ও রাবেয়া খাতুন একই সঙ্গে কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন মূলত পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের এক অগ্ৰনায়ক। যিনি চেয়েছিলেন মুসলিম জাতি সত্বাকে সকলের মাঝে তুলে ধরতে , চেয়েছিলেন লাঞ্চিত - বঞ্চিত অসহায় মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আর এই ক্ষেত্রে তিনি হাতিয়ার করেছিলেন সাংবাদিকতাকে। কারণ তিনি যেমন ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক তেমনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও ইসলামী পন্ডিত। শৈশব কালে গ্ৰামের মক্তবে শিক্ষা লাভ করেন, সেখানে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা ভালো ভাবে আয়ত্ব করেন। বহু চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়েই তিনি শেষ মেষ আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এফ.এম ডিগ্ৰি অর্জন করেন। অর্থাৎ তাঁর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিল না। কিন্তু জ্ঞানানুসন্ধানী আকরম খাঁ ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ও ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম থাকলেও অল্পবয়সেই তিনি সাংবাদিকতায় নিযুক্ত হন। তাঁর লেখালেখি শুরু হয় আকবার -ই - মোহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে। সাংবাদিকতা শুরু করেন সাপ্তাহিক আহলে হাদিস পত্রিকায়। তিনি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আযাদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। তিনি সম্পাদনা করেন ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা , ‘যামানা ‘ নামে উর্দু পত্রিকা। এই ‘ যামানা ‘ পত্রিকায় লিখতেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, আলী ভ্রাতৃদ্ধয়, মাওলানা সফর আলী প্রমুখ। তিনি ১৯৪৩ সালে ‘ কমরেড ‘ নামে আরেকটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে লেখার জন্য কারাদণ্ড ও ভোগ করেছেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি মুসলিম লীগের একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত খেলাফত আন্দোলন কমেটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ বিরোধী আজাদি আন্দোলন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তাঁর সম্পাদিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতায় একটি দীর্ঘস্থায়ী ভীত রচনা করেন। বাঙালি মুসলমানের ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে তাঁর ভূমিকা তৎকালীন সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল ঐতিহাসিক। তিনি ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ এবং সালাম , রফিক,বরকত সহ কয়েকজনের হত্যার প্রতিবাদে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু তিনি কালের চক্রে ১৯৬৮ সালের ১৮ আগষ্ট ঢাকার বংশালের আহলে হাদিস মসজিদে নামাজ পাঠরত অবস্থায় মৃত্যু বরন করেন।তিনি মুসলিম লীগের নেতা হলে ও বাস্তবে ছিলেন রাজনৈতিক - সাংস্কৃতিক অধিকারের বিষয়ে আপোষহীন। তাঁর জীবন শুধু বঙ্গীয় মুসলিম রেনেসাঁ নয় , বৃহত্তর বাঙালি চেতনার বিকাশে ও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রচিত মোস্তফা চরিত , আম্পারার বাংলা অনুবাদ , বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খৃষ্টধর্ম, মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস সহ আরো অনেক গ্ৰন্থ আজকের দিনে ও প্রাসঙ্গিকতা বহন করে। আজও যেন এই শতায়ু লোকটি বাংলা সাহিত্যের সর্বোপরি সাংবাদিকতার জগতে মহীরূহ রুপে সর্বদা বিচরণ করে চলেছেন ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct