আপনজন ডেস্ক: আমাতুল ওয়াহিদ সুতাইতা মাহামালি (রহ.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট গণিতবিদ। তাঁকে খ্রিস্টীয় দশম শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী গণিতবিদ মনে করা হয়। গণিতশাস্ত্র ছাড়াও তিনি ইসলামী আইন (ফিকহ) ও ফারায়েজ শাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন।
জন্ম : গণিতবিদ আলেমা সুতাইতা (রহ.)-এর সুনির্দিষ্ট কোনো জন্ম তারিখ জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, হিজরি চতুর্থ শতাব্দীর শুরুর ভাগে (খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী) আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় তাঁর পিতা আবু আবদুল্লাহ হুসাইন বিন ইসমাইল মাহামালি একজন বিচারক ছিলেন। বিচারক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল।
পারিবারিক ঐতিহ্য : মাহামালি সুতাইতা (রহ.)-এর পারিবারিক উপাধি। বাগদাদের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবার ছিল মাহামালি। যারা শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থবিত্ত ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে অগ্রগামী ছিল। বিশেষত আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাসের বিস্তৃত অঙ্গনজুড়ে পরিবারটির আলোচনা পাওয়া যায়। তবে শুধু আধুনিক বিজ্ঞান নয়, বরং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও চেতনার বিস্তারেও পরিবারটি অবদান রাখে। যেমন আলেমা সুতাইতা (রহ.)-এর দাদা ইসমাইল বিন মুহাম্মদ দাব্বি (রহ.) বাগদাদের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ইমাম মালিক (রহ.)-এর কয়েকজন ছাত্রের কাছ থেকে হাদিস শুনেছিলেন। তাঁর ছেলে আবুল হুসাইন মুহাম্মদ বিন আহমদ এবং আবুল হাসান মাহামালি উভয়ে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষাজীবন : পিতা আবু আবদুল্লাহ হুসাইনের তত্ত্বাবধানে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অনুসারে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর হাতেখড়ি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শুধু ধর্মীয় জ্ঞানের পাঠগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে তিনি প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগী হন। পিতা ছাড়াও সুতাইতা মাহামালি (রহ.) সে সময়ের বিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন। যেমন—ইসমাইল ইবনে আব্বাস আল-ওয়াররাক, আবদুল গাফির বিন সালামা হামসি, আবুল হাসান মিসরি, ইমাম হামজা আল-হাশেমি (রহ.) প্রমুখ।
গণিতশাস্ত্রে দক্ষতা : ১৫ বছর বয়সে তাঁর পিতা তাঁর হাতে আল-খাওয়ারিজমির ‘আল-কিতাবুল মুখতাসার ফি হিসাবিল জাবর ওয়াল মুকাবিলাহ’ তুলে দেন। সুতাইতা (রহ.) খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন যে, এই বইয়ের অর্ধেকের বেশি অংশেই রয়েছে উত্তরাধিকার সম্পদসংক্রান্ত গণিত। তিনি শুধু আল-খাওয়ারিজমির সমস্যাগুলোর সমাধান করেননি, বরং তিনি বিভিন্ন ধরনের সাধারণ সমাধানও তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের প্রথম উল্লেখযোগ্য নারী গণিতবিদ। তিনি ‘আল-কিতাবুল মুখতাসার ফি হিসাবিল জাবর ওয়াল মুকাবিলাহ’-এর অর্ধেক সমাধান করেন। তিনি ত্রিকোণমিতি জাতীয় সমীকরণের সমাধানে গণিতবিদ আবুল কালিমকে সহযোগিতা করেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টাগুলো পরবর্তী সময়ে তাঁদের উত্তরাধিকারী ইবনে হাইসাম ও ওমর খাইয়ামকে পথ দেখিয়েছিল। পশ্চিমা বিশ্ব আলেমা সুতাইতা (রহ.)-কে ‘জাগরণের নারী’ নামে স্মরণ করে।
ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য : আলেমা সুতাইতা (রহ.)-কে ইতিহাস একজন গণিতবিদ হিসেবে চিহ্নিত করলেও তিনি ফিকহ (ইসলামী আইন) ও হাদিস শাস্ত্রের পাঠ দান করতেন। বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাসান বিন মুহাম্মদ আল-খাল্লাল তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। খতিবে বাগদাদি (রহ.) তাঁর সম্পর্কে লেখেন, তিনি কোরআন মুখস্থ করেন এবং ফিকহে শাফেয়ির ওপর দক্ষতা অর্জন করেন। হিসাববিজ্ঞান, ইলমুল ফারায়েজসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল। তিনি তাঁর সময়ে শাফেয়ি মাজহাবের বিধি-বিধান আত্তীকরণে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। এমনকি তিনি ফাতাওয়া প্রদান করতেন। ইমাম জাহাবি (রহ.) লেখেন, সুতাইতা মাহামালি (রহ.) ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ আলেম, অভিজ্ঞ আইনবিদ ও দক্ষ ফাতাওয়া প্রদানকারী। তিনি কোরআন ও ফিকহে শাফেয়ি মুখস্থ করেন এবং ফারায়েজ শাস্ত্রে (উত্তরাধিকারসংক্রান্ত ধর্মীয় বিধান) বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।
গণিতশাস্ত্রে অবদান : যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফাউন্ডেশন অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড সিভিলাইজেশনের (এফএসটিসি) প্রেসিডেন্ট এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম হাসানি বলেন, ‘আব্বাসীয় যুগে গণিতচর্চায় তাঁর সামগ্রিক অবদান রয়েছে। তিনি একজন গণিতবিদ হিসেবে আদালতকে সহযোগিতা করতেন। জটিল মামলায় সমস্যাগুলোর গাণিতিক সমাধান ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে তিনি বিচারককে সহযোগিতা করতেন। যেমন—একজন শ্রমিক যদি বাড়ির আংশিক কাজ করার পর আর কাজ করতে না চায়, তবে তার মজুরি কত হবে এবং তা কিভাবে নির্ধারণ করা হবে।’
মৃত্যু : আলেমা সুতাইতা (রহ.) ৩৭৭ হিজরির রমজান মাসে মোতাবেক ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
তথ্যঋণ : কিসসাতুল ইসলাম, মুসলিম হেরিটেজ ও আলে কুতুব ডটকম
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct