বলাকা
হাবিবুর রহমান
সত্তর দশকে গ্রাম বাংলায় মানুষের দুঃখ দুর্দশার অন্ত ছিল না। হারুন পাড়াগাঁয়ের ছেলে। জল কাঁদায় মানুষ। গরীব পরিবারের বড় ছেলে। তিন ভাই, চার বোন। বাবা চটকলে বদলি শ্রমিক। কোন হপ্তায় কাজ হয়, কোন কোন হপ্তায় আবার কাজ হয় না। টেনেটুনে সংসার চলে। পাশের বাড়িতে মা মাস্টার গিন্নির রান্নাশালে কাজকর্ম করে দেয়। গিন্নিমা বড় দয়ালু। এঁটোকুটো, ভাত পান্তা যা দেয়, তাই নে মা বাচ্চাদের মুখে তুলে দেয়। তা হারুনের মাথা ভালো। ক্লাসে প্রতিবছর প্রথম হয়। মাস্টাররা তাকে খুব ভালবাসে, উৎসাহ দেয়। সংসারে তো বড্ড টানাটানি। মেজ পড়া ছাড়লো। কলকাতায় ফেরিকরা এক কাকু তাকে সাহেবের বাড়িতে রান্নার কাজে লাগিয়ে দিল। সংসারটা কিছুটা হলেও হালকা হল। হারুন তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবার চটকল গেল বন্ধ হয়ে। বাবা বাড়িতে ঠায় বসে। পেট মহাজন বড় মহাজন। অতগুলো পেট চলবে কি করে?বাধ্য হয়ে বাবা ট্রেনে হকারি করতে লাগলো। ফেরে অনেক রাতে। লাভের টাকায় চাল ডাল কেনে, তা ফুটিয়ে কোন ভাবে দিন চলে। কোন কোন দিন পুঁজির টাকা ভেঙে চালডাল কেনা হয়।
অভাব মানুষের লজ্জা কেড়ে নেয়। পরার লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে, বাধ্য হয়ে মায়ের কাপড় দু’ফারতা করে পরে বাবা লজ্জা ঢাকে। ঐ কাপড়ে হকারি করে। পাড়ার লোক ঠাট্টা করে, হারুনরা চোখ বুঝে সহ্য করে। ঘোর শীতকাল। বাবা জ্বরে কাতরায়। ঘরে দানাপানি নেই। বড় অসহায়, সংসার অচল। বই খুললে ছরছরিয়ে জল আসে হারুনের পড়া দুচোখ থেকে। রাতে বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, চলো খোকা, এক জায়গায় যাই। কিছু মিললেও মিলতে পারে।গভীর রাতে হালকা চাদরে বাপবেটা দুজনে জড়াজড়ি করে তিন মাইল রাস্তা হেঁটে সবজির ট্রেন ধরলো। ভোরে শিয়ালদা স্টেশন। আলো ফুটলে গেল মেজর রান্না সালে। মেজকে দেখে হারুনের চোখের জল বাঁধ মানলো না, হ্যাঁরে তোর কি শরীর খারাপ? এত রোগা দেখাচ্ছে কেনরে তোকে?মেজ বড়দাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল, কই না তো দাদা, আমি ভালো আছি।বাবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, মেঝেয় মেজোর কম্বলে শুয়ে পড়ল। কর্তা গিন্নি ঘুমোচ্ছে। তাদের ডিস্টার্ব করা যাবে না। ঠিক নটা। মেম সাহেবরা এলেন। হারুনদের দেখে ব্যাজার, মাইনে তো দিয়ে দিয়েছি বাপু, তা আবার কেন? আর তোমাদের ছেলেও কাজের ছেলে নয়, ওর পেছনে আমার অনেক সময় ব্যয় করতে জানো?বাবা কাঁপতে কাঁপতে বললেন, মাগো বড় অসহায় হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আমার এই ছেলে কেলাসে প্রথম হয়, তার বই কিনতে পারিনিগো মা। মেমসাহেবরা আরো ব্যাজার, ওসব বাহানা এখানে চলবে না। না পোষালে তোমাদের ছেলেকে নিয়ে যাও বাপু, লেঠা ঝুঁকে যাক। ইতিমধ্যে সাহেবের ডাক পড়লো, ভয়ে ভয়ে বাপবেটায় ভেতরে ঢুকলো। মাটির মানুষ। সব শুনলেন, সহানুভূতিও দেখালেন। কিন্তু মেমসাহেবা ধমক দেন।সাহেব মিষ্টি করে বললেন, তোমার এত উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই। সবাই কিন্তু চোরজোচ্চর মিথ্যুক নয় বুঝলে?তিনি মিষ্টি করে বললেন, আহারে কত কষ্ট করে এসেছে। মেজকে ডেকে সাহেব বললেন, যাও রান্নাশালে তোমার বাবা দাদাকে খেতে দাও।হারুনের চোখে জল এসে গেল। ঠিক সাড়ে দশটায় গাড়ি নীচে এসে দাঁড়ালো। ফুডের বড় অফিসার। হারুনদের নিয়ে তিনি অফিসে গেলেন। একে একে তার চেম্বারে সবাইকে ডাকলেন, এবং হারুনকে দেখিয়ে বললেন, ছেলেটি খুব মেধাবী। টাকার অভাবে বই কিনতে পারছে না। আসুন না আমরা সবাই তাকে সাহায্য করি। কার মধ্যে কি লুকিয়ে আছে কে জানে বলুন!সাহেব মানিব্যাগ খুলে ১০০০ টাকা রাখলেন টেবিলে। মিনিট দশেকের মধ্যে আরও চার হাজার টাকা উঠলো। সেই টাকা হারুনের হাতে দিয়ে তিনি বললেন, যাও মন দিয়ে লেখাপড়া করো, খুব বড় তোমাকে হতে হবে বুঝলে?হারুন আবেগে কেঁদে ফেললো। সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলেন, আমার মতন হতে হবে বুঝলে.আমিও একদিন তোমার মতন অসহায় ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে হারুন তার পায়ে গড় হয়ে প্রণাম করলো। কালের স্রোতে সেই হারুন আজ প্রতিষ্ঠিত। সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। সকল কষ্ট, প্রতিকূলতা পার করে আজ হারুন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে.অবসরে একলা হলে খোলা আকাশের দিকে তাকায়। টাউনের লোকেরা বলে বলাকা। হারুন ছিল গাঁয়ের ছেলে, একে বক বলে জানে। গোধূলি বেলায় কত বক সারিসারি উড়ে যায়। কি ভালো যে লাগে হারুনের!ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই তার মা-বাবা আছে, আর আছেন সেই সাহেবও। তাই নয় নয় কি?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct