নজরুল আজ ও প্রাসঙ্গিক
মোফাক হোসেন
অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখে সমগ্র দেশকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমস্ত প্রতিভাকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ১২৪ তম জন্ম বর্ষে অন্ধকারে অশুভশক্তির নগ্ন উল্লাস। ক্ষতবিক্ষত করছে মূল্যবোধ লাঞ্ছিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য,তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজী নজরুলের জন্ম জয়ন্তী উদযাপন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কবি বলেছেন যেদিন আমি চলে যাব দূর তারার দেশে চলে যাব কত প্রশংসা হবে কত বক্তার পর বক্তা বিশেষণের পর বিশেষণ দেবে। নজরুল কে ঘিরে আমার হৃদয়ে যে আবেগের উচ্ছ্বাস ছিল তা কয়েকটি শব্দেই বিধৃত করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়-”ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নি নজরুল” তাই রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি স্মরণ করতেই হয় শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ। বর্তমানে এই ছোট্ট চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে বাংলা ১৩০৬ ১১ই জ্যৈষ্ঠ রোদ,তাপ,দগ্ধ দিনে নজরুল জন্মগ্রহণ করেন। নজরুল লোক প্রিয় কবি। কবির জীবদ্দশায় তার মত লোক প্রিয় হয়ে উঠেননি বাংলার আর কোন কবি। অত্যাচারিত অপমানিত মানবতার মুক্তির জন্য কবি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে ও। লেবার ও স্বরাজ পার্টি গঠন করে তিনি তার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। সৃষ্টির আশাতেই পুরাতন সমাজকে আঘাত করেছেন-আমি বিদ্রোহ করেছি -বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে- যা মিথ্যা কলুষিত পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। কবি নজরুল এক বিশ্বময় কর প্রতিভা বাংলার আন্তর্জাতিক সংগীতের প্রথম অনুবাদক ও কাজী নজরুল ইসলাম- ১৯২৬ সালে কলকাতা মহানগরী যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত তিনি হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছে প্রশ্ন রাখলেন দেশের চরম দুর্দিনে পরাধীনতার শৃংখল মোচন জরুরী নাকি কে হিন্দু আর কেইবা মুসলমান তা বিচার করা প্রাসঙ্গিক। তাই তিনি গর্জে উঠলেন -”অসহায় জাতি মরেছে ডুবিয়া জানে না সন্তরণ কান্ডারী আজ দেখিবো তোমার মাতৃ মুক্তিপণ! হিন্দু না ওরা মুসলিম?ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। ”নারীকে উপযুক্ত মর্যাদা ছাড়া যে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয় সে কথা বহু আগেই কবি উপলব্ধি করেছিলেন তাই নারীর অবমাননা দেখে ব্যথিত নজরুল বললেন-ফাঁসির কয়েদীদের ও এইসব অভাগিনীদের অপেক্ষা অধিক স্বাধীনতা আছে। তাই তার কন্ঠে -”বিশ্বে যাহা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। ”
পরক্ষণেই তিনি নারী সমাজকে আহ্বান করেছেন-চোখে চোখে আজ চাহিতে পারনা, হাতে রুলি পায়ে মল মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেলো নারী,ভেঙে ফেল ও শিকল! যে ঘোমটা তোমায় করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ,দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন যেথা যত আভরণ। স্বাধীনতার সংগ্রাম নিয়ে কবির চিন্তার সঙ্গে আপোষকামী ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব বাধে- এবং বিপ্লবীদের দুঃখ ছিল -নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বললেন-”রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে,সে শুধু পশল না মা অন্ধকারের বন্ধ ঘরে। ছিল দুজনের সম্পর্ক পারস্পরিক ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় নিবিড়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকাল প্রয়াণের পর আয়োজিত শোক সভায় বিশ্ব কবির পাশের আসনটিতে বসেছিলেন নজরুল রবীন্দ্র অনুরাগী এবং নজরুল বিদ্বেষীদের অবাক করে দিয়ে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আয়োজনে কবিগুরুর ৬০ বছর বয়স পূণ্য সংবর্ধনা সভায় কবিগুরু প্রথমে ঢুকলেন,সভা শুরু হওয়ার একটু আগে নজরুল ঢুকেই মঞ্চে উঠেই কবি গুরুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। এবং কবিগুরুর ইশারা মত তার পাশের আসনটিতেই বসলেন। ”যখনই স্বাধীনতা সংগ্রামে আপোষ কামি নেতৃত্বের রাস টেনে ধরেছেন, নজরুল তখনই গর্জে উঠেছেন-চরকা দিয়ে কি আসতে পারে স্বাধীনতা? তাই কবি হুংকার দিয়ে বললেন-”সুতা দিয়ে মরা স্বাধীনতা চাই বসে বসে কাল গুনি জাগরে জোয়ান বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি। ” তাই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছেন-কবিরা সাধারণ তো কমল ভীরু, কিন্তু নজরুল তা নন। কারাগারে এই শৃংখল পড়ে বুকের রক্ত দিয়ে তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালির প্রাণে এক নতুন অনুরণন ঘটেছে। বিপিনচন্দ্র পাল লিখেছেন- তার লেখায় গ্রামের ছন্দ মাটির গন্ধ পাই,দেশে যে নতুন ভাব জন্মাচ্ছে তার সুর তা-ই। তাতে পালিশ বেশি নেই আছে লাঙ্গল এর গান কৃষকের গান। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের মতে-তার লিখার প্রভাব অসাধারণ,তার গান পড়ে আমার মত বেরসিক লোকেরও জেলে বসে গাইতে ইচ্ছে করে। আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তার গান গাইবো। আমি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু নজরুলের মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না। শিক্ষা সম্বন্ধে অনেক আগেই তরুনের কাছে আবেদন করেছেন নজরুল-তোমাদেরই শিক্ষা তোমাদের জ্ঞান অর্জন যদি তোমাদের মাঝেই নিঃ শোষিত হয়ে যায় তবে ভুলে যাও এই শিক্ষা,বর্জন কর জ্ঞান অর্জন। নত্ত করীর জন্য দাসখৎ লিখার কায়দা কানুন শেখার জন্য যদি তোমরা শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করো,তবে জাহান্নামে যাক তোমাদের এই শিক্ষা পদ্ধতি এই শিক্ষালয়। নজরুল জীবনে দুঃখ পেয়ে এক সময় বলেছেন”আগুন যেমন ধাতুকে পুড়িয়ে খাঁটি করে - দুঃখ ও তেমনি আত্মাকে একেবারে আয়নার মতো সাফ করে দেয়। ”কিন্তু প্রতিবছর জন্ম বর্ষ উদযাপন অথবা তাঁর নামে বিশ্ববিদ্যালয়, রেলস্টেশন, বিমান বন্দর-এর নামকরণ ,গুটি কয়েক তাঁর মোড়ে মোড়ে অবয়ব উম্মোচন করেই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করে দিতে পারি না। আমাদের মনে রাখতে হবে তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি গুলি, হাঁটতে হবে তাঁর দেখানো পথে ও মনে রাখতে হবে অসাধারণ প্রতিভার কথা। সবশেষে তার একটি উক্তি -”আমার বাঁশি বিরহ যমুনার তীরে ফেলে চলে যাব, সেই রুক্ষ বালুচর থেকে সেই বেনু কুড়িয়ে যদি অন্য কেউ বাজাতে পারেন, আমার ফেলে যাওয়া বাঁশি ধন্য হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct