আজ থেকে একশো চব্বিশ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন। মারা গিয়েছিলেন সাতচল্লিশ বছর আগে। লিখতে পারেননি জীবনের শেষ চৌত্রিশ বছর। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। গত ২৪ মে ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে বর্তমানে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন সেকথাই বলবেন এই প্রবন্ধে হিঙ্গলগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শেখ কামাল উদ্দীন...
আজ থেকে একশো চব্বিশ বছর আগে তিনি জন্মেছিলেন। মারা গিয়েছিলেন সাতচল্লিশ বছর আগে। লিখতে পারেননি জীবনের শেষ চৌত্রিশ বছর। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। গত ২৪ মে ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁকে বর্তমানে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন। কেন প্রয়োজন সেকথাই বলবো এই প্রবন্ধে। আজ ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, জাত-পাতের লড়াই, অসহিষ্ণুতা, অনার কিলিং, গণপিটুনি, শ্রমিকের প্রতি শাসকের অহেতুক শোষণ, কর্মসংস্থানের অভাব, সবমিলিয়ে একটা অস্থির পরিস্থিতি। ‘মানুষ বড় অসহায়। ’ কোথায় তার আশ্রয়? শান্তির ললিত বাণীতে হবে না। তার এখন ক্ষুধার অন্ন চাই। পরনের প্রয়োজনীয় বস্ত্র চাই। শান্তিতে ঘুমানো চাই। কাজে গেলে সন্তান, স্বামী, বাবা যেন দিনান্তে সুস্থভাবে বাড়ি ফেরে তার গ্যারান্টি চাই। চাই বলেই নজরুলের জীবন ও সৃষ্টি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। একদা নজরুল ১৯২৬ এর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কৃষ্ণনগর অধিবেশনে উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে নিজে গান লিখে গেয়েছিলেন–“হিন্দু না ওরা মুসলিম?”ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী? বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! দেশের গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ ছাড়া একথা আজ আর কেউ মনে রাখছেন? তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শুধু সৃষ্টি নয়, ব্যক্তি জীবন লক্ষ্য করলেও তাঁর অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১০০ বছর আগেও যেভাবে তিনি তাঁর সম্প্রীতির পরিচয় ব্যক্তিজীবনে রেখেছিলেন তা বোধহয় একালের অতি আধুনিক প্রগতিশীল মানুষও চিন্তা করতে পারবেন না! কবি তাঁর প্রথম সন্তান, যিনি বাল্যেই মারা যান তার নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। আজ যখন রাম- রহিমের দ্বন্দ্বে আমরা ভারতীয়রা নিজেদের স্ব স্ব ধর্মের বাইরে এনে নিজেকে হিন্দু মুসলমানে আবদ্ধ না রেখে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারছি না তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পুত্রের নাম রাখলেন একদিকে হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ ও অন্যদিকে ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ-এর নাম একত্রে যুক্ত করে! এই সাহস এ কালের কোন অতি আধুনিক ব্যক্তিও রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। নজরুলের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা যেটি গান হিসেবেও গাওয়া হয়– ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছে জুয়া/ ছুঁলেই তোর জাত যাবে জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া। ’ আজকে যখন খবর পাওয়া যায় অত্যাচারে জর্জরিত তথাকথিত নিম্নজাতের মেধাবী ছাত্র আত্মহত্যা করে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকর্মীর কাছ থেকে জাত নিয়ে কটূক্তি শুনতে হয় তখন কাজী নজরুল ইসলাম প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।
নারীকে সম্মান দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার?’ সেখানে প্রশ্ন রেখেছেন কবি। কাজী নজরুল প্রশ্ন নয়। সরাসরি বলেছেন পাপে যদি নারীকে দায়ী করা হয়, পুণ্যেও আছে তাঁর সমানাধিকার। পাপ হোক, পুণ্য হোক দু’জনেই সমান। ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। ’ আজ ভারতবর্ষের লোকসভায়, বিধানসভা সভাগুলোতে মহিলা সংরক্ষণ বিলে কেন এতো আপত্তি। পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় পঞ্চায়েতে মহিলাদের আসন সংরক্ষিত হয়েছে। প্রশংসনীয় এই উদ্যোগ। এখানে ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সারা দেশে, সব রাজ্যে এই উদ্যোও গ্ৰহণ করতে হবে। এখানেই নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা।কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামাসঙ্গীত পশ্চিমবঙ্গের কালীপুজোর মন্ডপগুলোতে বাজতে থাকে। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই সেই গানগুলোর রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম। ‘মহাকালের কোলে এসে’, ‘বল রে শ্যামা বল’, ‘অরুণকান্তি কে গো’, ‘আমার কালো মেয়ের’ এই গানগুলো যিনি রচনা করেন তিনিই আবার লেখেন ‘আল্লাহ যে পাইতে চায়’, ‘হে নামাজী’, ‘তোরা দেখে যা আমিনা’, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’। হিন্দু বা মুসলমান নয়, সর্বধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত মানুষ না হ’লে এই গান লেখা যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তিনি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আজ জাত-পাতের জন্য লড়াই নয়, ভাতের জন্য লড়াই করি; হিন্দু-শিখ-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা নয়, মিলনের জন্য লড়াই করি, সম্প্রীতির জন্য লড়াই করি; শাসকের কায়েমি স্বার্থের জন্য নয়, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য লড়াই করি; শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে নয়, মানুষের হয়ে লড়াই করি; মানুষের জন্য গলা ফাটাই, কবি গেয়েছিলেন ‘গাহি সাম্যের গান’। সেই সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য, সমনাধিকারের জন্য এবং যতদিন পর্যন্ত তা না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এ লড়াই, এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তাহলেই কবির ভাষায় বলতে পারি, ‘আমি সেই দিন হব শান্ত’। তাহলেই কবির জন্মদিনে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct