দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান; পূর্ব এশিয়ার চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার—এই পাঁচ দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের। সেখানে রয়েছে সাতটি রাজ্য। এর মধ্যে অন্যতম মণিপুর রাজ্য। এই রাজ্যে ৩ মে থেকে শুরু হওয়া সংঘাত–সহিংসতা আগামী দিনে ভারতসহ গোটা অঞ্চলের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, তা সামনে আসছে। লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী।
দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান; পূর্ব এশিয়ার চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার—এই পাঁচ দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের। সেখানে রয়েছে সাতটি রাজ্য। এর মধ্যে অন্যতম মণিপুর রাজ্য। এই রাজ্যে ৩ মে থেকে শুরু হওয়া সংঘাত–সহিংসতা আগামী দিনে ভারতসহ গোটা অঞ্চলের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, তা সামনে আসছে। এই প্রতিবেদনে মণিপুর রাজ্যের অনেকের সঙ্গে কথা বলা হলেও নিরাপত্তার কারণে তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
ঘটনা : মার্চ মাসে মণিপুর হাইকোর্ট এক নির্দেশে রাজ্য সরকারকে বলেছিলেন, মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুপজাতি (উপজাতিভুক্ত নয় এমন সম্প্রদায়) মেইতেই সম্প্রদায় তফসিলি আদিবাসী হিসেবে সংরক্ষণ পেতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখতে। নির্দেশটি হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে ১৮ এপ্রিল প্রকাশ করার পরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে উপজাতি সম্প্রদায়। বিক্ষোভ দিন কয়েকের মধ্যেই সহিংস আন্দোলনের রূপ নেয়। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের পাশের জেলা চূড়াচাঁদপুরে ৩ মে উপজাতি ছাত্রদের একটি মিছিল বের হয়। কিছুটা গুজবের কারণে এবং মিছিলে অস্ত্র থাকার খবরে হিংসা ছড়াতে শুরু করে ইম্ফলের আশপাশে, চূড়াচাঁদপুরে এবং সংলগ্ন অন্তত আরও চার জেলায়। এক দিনে মৃত্যু হয় অন্তত ২০ জনের। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৭০ জনের বেশি। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। সংঘাত শুরু হওয়ার দু–এক দিন পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছিলেন, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে ১ হাজার ৭০০ বাড়িঘর, সম্পত্তি। অসংখ্য আহত। কত মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন বলা মুশকিল।সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে অবস্থা সামাল দিচ্ছে রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার। কিন্তু পাহাড়ে এখনো গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে চূড়াচাঁদপুরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন। স্পষ্টই এই শান্তি ক্ষণস্থায়ী।
ঘটনার কারণ : এই হিংসার অন্যতম কারণ বিভিন্ন গণতন্ত্রকামী শক্তির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘তাতমাদো’র লড়াই। গৃহযুদ্ধের তীব্রতা যত বেড়েছে, মিয়ানমার থেকে মণিপুরে শরণার্থীদের আসা তত বেড়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে শরণার্থী আসা। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশের কারণে বছর ছয়েক আগে ভুগতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। আর আজ সামরিক দমনমূলক শাসনের কারণে বিপদে পড়েছে ভারত। মণিপুরের সহিংসতা তারই পরিণাম। পশ্চিম মিয়ানমারের দুটি প্রদেশ সাগাইন ও চিনের সঙ্গে মণিপুরের ৪০০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে সেখানে গণতন্ত্রকামী সশস্ত্র সংগঠনের ওপর হামলা চলছে। শরণার্থীরা হাজারে হাজারে মণিপুরে এবং পাশের রাজ্য মিজোরাম ঢুকছেন। যাঁরা ঢুকছেন, তাঁদের সঙ্গে ‘এথনিক’ বা জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে মণিপুরের অরণ্য ও পাহাড় অঞ্চলে বসবাসকারী পাঁচটি প্রধান উপজাতির। এঁরা হলেন কুকি-চিন-মিজো-যমি-হামর, যাঁদের সার্বিকভাবে কুকি জনগোষ্ঠীর আওতাভুক্ত করা হয় খানিকটা বোঝার সুবিধার জন্যই। এঁরা ছাড়া মোটামুটি আরও ৩০টি উপজাতি রয়েছেন, প্রধানত মণিপুরের অরণ্য-পাহাড়ে। যাঁরা প্রবেশ করছেন, তাঁরা পাহাড়-অরণ্য অঞ্চলে এসে বসবাস করছেন বলে সরকারের অভিযোগ। এ কারণে ৯৬৬টি নতুন গ্রাম ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। এরা সরকারি স্বীকৃতি চেয়েছে বলেও গত বছরে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মণিপুরের সংবাদপত্র ইম্ফল ফ্রি প্রেস। এই পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার পরিবেশ মণিপুরে অতীতেও ছিল, সংঘাতের পরে আরও বেড়েছে। উত্তর–পূর্ব ভারতের দীর্ঘ বঞ্চনা ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং তার জেরে ভিন্ন রাষ্ট্রের দাবিতে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। ছোট–বড় সব জাতিগোষ্ঠীর এখনো নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী এবং কমবেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে, যে কারণে সাম্প্রতিক সংঘাত দ্রুত ছড়িয়েছে। বর্তমানে উত্তর–পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যে কিছু না কিছু সমস্যা রয়েছে। এ অবস্থায় মণিপুরসহ উত্তর–পূর্ব অশান্ত হলে ভারতের সমস্যা বাড়বে।
এই পরিস্থিতিতে চাপে পড়েছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। মণিপুর এবং উত্তর–পূর্ব ভারতসহ সম্ভবত বিশ্বের আদিমতম কিন্তু আধুনিক বিতর্ক হলো কে ভূমিপুত্র আর কে বহিরাগত। এই বিতর্ককে শাণিত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প (২০১৬), আর ক্ষমতায় রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি থেকে বিশ্বের অনেক নেতা। ফলে মণিপুরকে দোষ দেওয়া যায় না। মণিপুরের প্রধান অনুপজাতি সম্প্রদায় মেইতেইরা নিজেদের ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করেন। এটা করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের রাজপরিবারের প্রাচীন নথি ‘চেইথারোল কুমপাবা’ থেকে উদ্ধৃত করে দেখান, সুসভ্য ও সুসংহত মূল নিবাসী হিসেবে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে তাঁরা মণিপুরে রয়েছেন। এ নিয়ে বিশেষ বিতর্ক নেই। কারণ, ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মেইতেইদের (যাদের মধ্যে অবশ্য সবকিছুতেই প্রাণ থাকার তত্ত্বে বিশ্বাসী ‘অ্যানিমিস্ট’, খ্রিষ্টান, হিন্দু, মুসলমান, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি থেকে তপসিলি জাতির মানুষ রয়েছেন) ভূমিকা অনস্বীকার্য। মহাভারত থেকে রবীন্দ্রনাথ—সবাই মণিপুর অঞ্চলের মানুষের কথা বলেছেন। সমস্যা অন্যত্র। মণিপুরিদের বক্তব্য, সুসভ্য জাতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন। তাঁরা সরকারিভাবে জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ হলেও বসবাস করেন প্রধানত ইম্ফল ও সংলগ্ন উপত্যকা অঞ্চলে, যার আয়তন রাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ। অনেকটা বাটির আদলে যদি চিন্তা করি, তাহলে দেখা যাবে, ইম্ফলের সমতল-উপত্যকায় রয়েছেন মেইতেইরা, আর উপজাতিরা রয়েছেন উঁচু পাহাড় অঞ্চল ঘিরে। কিন্তু মেইতেইরা পাহাড়-অরণ্য অঞ্চলে জমি কিনতে পারেন না। কারণ, তা আদিবাসী অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে রয়েছেন নাগা, কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির মানুষ। তাঁরা জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ, অথচ এই অরণ্য-পাহাড় মণিপুরের ৯০ শতাংশ এলাকাজুড়ে রয়েছে। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ অনুপজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট উপত্যকায় জমি কিনতে পারেন। একে পুরোপুরি ‘বৈষম্য’ বলে চিহ্নিত করছেন মেইতেইরা। তা ছাড়া মিয়ানমার থেকে শরণার্থী ঢুকতে শুরু হওয়ায় আর কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই মেইতেইরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন, এমন আশঙ্কা অনেকেরই। এমনকি মনেপ্রাণে বামপন্থী এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নিংথৌজারও মনে করেন, এভাবে চললে সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস—সবকিছু হারিয়ে যাবে। এ কারণে মেইতেইরা তফসিলি উপজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে সংরক্ষণের সুবিধা পেতে চান। সেই আবেদনে সাড়া দিয়েই হাইকোর্ট সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেন।
অপর দৃষ্টিকোণ : কুকিসহ অন্যান্য উপজাতির দৃষ্টিকোণ ভিন্ন। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং একজন মেইতেই। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন, বিধানসভায় ৬০ সদস্যের মধ্যে ৪১ জন মেইতেই। মেইতেইরা সবদিক দিয়ে উপজাতিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
সৌ: প্র: আ:
পরবর্তী অংশ আগামী কাল..
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct