গত এক বছরের বেশি সময় ইউক্রেন যে ওয়ার অন আট্রিশন বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যুদ্ধ (এমন একধরনের যুদ্ধকৌশল, যেখানে এক পক্ষ কিংবা দুই পক্ষই অপর পক্ষের সেনা ও রসদ নিঃশেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে যায়) করে চলেছে, সত্যিকার অর্থে তার ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। এ ধরনের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যুদ্ধকৌশল কখনোই দ্রুত ফল বয়ে আনে না। এ যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে, সে রকম কিছু ধারণা করা শিশুতোষ একটা ধারণা। লিখেছেন ফ্যাঙ্ক লুডভিগ।
এই লেখা যখন আপনি পড়ছেন, সে সময় ইউক্রেনের তরুণ-তরুণীরা নতুন করে সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এবং বসন্তকালীন আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ অভিযানের জন্য দেশটির ব্রিগেডগুলো প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে। যদিও মিত্রদের দিক থেকে ব্যাপক চাপ আছে যে ইউক্রেনকে তারা যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়েছে, সেগুলো যেন রাশিয়ার কাছে তারা যেসব ভূখণ্ড হারিয়েছে, পুনরায় তা জয় করে নেওয়ার কাজে সেগুলো ব্যবহৃত হয়।ইউক্রেনের কর্তাব্যক্তিরা সেটা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালালেও এই অভিযান থেকে সে রকম নিষ্পত্তিমূলক কিছু অর্জন হবে বলে আশা করা যায় না। পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া ও বিশাল কোনো অর্জনের বদলে এই অভিযানে ধীর ও প্রলম্বিত কিছু অর্জনই হবে ইউক্রেনের। গত এক বছরের বেশি সময় ইউক্রেন যে ওয়ার অন আট্রিশন বা মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যুদ্ধ (এমন একধরনের যুদ্ধকৌশল, যেখানে এক পক্ষ কিংবা দুই পক্ষই অপর পক্ষের সেনা ও রসদ নিঃশেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে যায়) করে চলেছে, সত্যিকার অর্থে তার ক্ষয়ক্ষতি বিপুল। এ ধরনের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যুদ্ধকৌশল কখনোই দ্রুত ফল বয়ে আনে না। এ যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে, সে রকম কিছু ধারণা করা শিশুতোষ একটা ধারণা। ‘সামনের বড়দিনের আগেই এই যুদ্ধ শেষ হবে’, এ রকম কোনো ধারণার আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। বাস্তবে সেটা হচ্ছে না। সম্ভবত, পরের বড়দিনের আগেও সেটা ঘটা সম্ভব নয়। সেই প্রচেষ্টা যদি মধ্য মেয়াদে (এক থেকে তিন বছর) এবং দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই করতে হয়, তাহলে অনন্যসাধারণ প্রচেষ্টা দরকার। সে ক্ষেত্রে সামরিক রসদের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এখন যা দেওয়া হচ্ছে, নিশ্চিতভাবেই তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় বাড়াতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এবারের গ্রীষ্ম শেষ হলে আমরা দেখতে পাব, ইউক্রেন বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে, কিন্তু তাদের ভূখণ্ড থেকে রাশিয়াকে হঠাতে পারেনি। পূর্ব দিক থেকে একই ধরনের হুমকি বিরাজ করছে। একটি সামরিক ও কূটনৈতিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এ মাসের শুরুর দিকে কিয়েভে গিয়েছিলাম। ইউক্রেনীয় একজন জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যদি এক শব্দে একটি বার্তা দিতে বলা হয়, তাহলে সেই শব্দ কী হবে? তাঁর উত্তর ছিল ‘স্থিতিশীলতা’। ইউক্রেনীয়রা ভাবছেন, কীভাবে দীর্ঘকালের জন্য তাঁদের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি টেকসই রাখা যাবে। রাজনৈতিক পরিসরে, ঘটনাক্রমে ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখেছে ইউক্রেন। জুলাই মাসে লিথুনিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ন্যাটোর আসন্ন সম্মেলনে সংস্থাটির নেতারা বিষয়টি কীভাবে বোঝাপড়া (যদি সেটা তাঁরা আদৌ করেন) করবেন, এখন সেটা দেখার বিষয়। সামরিক দিক বিবেচনা করলে, পশ্চিমারা যে ধরনের ও যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তা দিয়ে কিয়েভের পক্ষে রাশিয়ার কাছ থেকে তাদের নিজেদের ভূমি ফিরিয়ে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী এখন পর্যন্ত যে অস্ত্র ও গোলাবারুদের ওপর নির্ভর করে বিস্ময়কর সফলতা পেয়েছে, তার বিশাল অংশই সাবেক সোভিয়েত জামানার। ন্যাটোর সামরিক সরঞ্জাম ইউক্রেনের অস্ত্রভান্ডারে যুক্ত হলেও সেগুলো এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়নি। যুদ্ধে যতই পুরোনো অস্ত্র ও গোলাবারুদে টান পড়বে, ততই নতুন ও অপেক্ষাকৃত ভালো অস্ত্র ও গোলাবারুদের বিশাল চাহিদা বাড়তেই থাকবে।
ট্যাংকের বিষয়টিই বিবেচনা করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো এ পর্যন্ত ১৪০টি আধুনিক ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জার্মানি জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনকে ১৮টি লিওপার্ড-২ এস ট্যাংক (কিয়েভে এ বিষয়ে যে গুজব চালু রয়েছে তা হলো, এর মধ্যে অর্ধেক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়) দিয়েছে। জার্মানি সামরিক সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় আরও কিছু ট্যাংক দিচ্ছে, অবশ্য সেগুলো আগের লিওপার্ড-১ এস মডেলের। যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংক দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ৩১টি আব্রাহাম-২ ট্যাংক এবং ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস যৌথভাবে ১৪টি ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া স্পেন, কানাডা, পোল্যান্ড ও নরওয়ে আরও বেশ কয়েকটা ট্যাংক দিতে চেয়েছে। যাহোক, যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম ট্যাংকস এ বছরের শরতের আগে কিয়েভে পৌঁছাবে না। আর ডেনমার্ক ও নেদারল্যন্ডসের ট্যাংক আগামী বছরের শুরুর আগে ইউক্রেন পাবে না। গত সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি আসন্ন অভিযানের জন্যই পশ্চিমাদের কাছে ৩০০টি ট্যাংক চেয়েছিলেন। অথচ এখন পর্যন্ত জালুঝনি ১০০-এর সামান্য কয়েকটি বেশি ট্যাংক এবং আরেকটু বেশি সংখ্যক সাঁজোয়া যান পেয়েছে। স্বল্প মেয়াদে ন্যাটোর দেশগুলো সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ (বিশেষ করে কামানের গোলা) সরবরাহ করতে চাপে পড়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভান্ডারে দুই হাজারের বেশি সংখ্যক এমআইএ২ আব্রাহাম ট্যাংক মজুত আছে। এ ছাড়া হাজার হাজার সাঁজোয়া যানও তাদের রয়েছে। ফলে প্রতিশ্রুত যুদ্ধ সরঞ্জাম ইউক্রেনের কাছে না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি বিবেচনা করে বলাই যায়, চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর কোনো কারণ নেই যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে ইউক্রেনে যদি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ যদি ব্যবহার করা না হয়, তাহলে সেগুলো কখনোই আর ব্যবহৃত না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার পেছনে পশ্চিমের মৌলিক স্বার্থ যদি হয় যুদ্ধে কিয়েভ বিজয়ী (যদিও কিছু কিছু সময় এ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়) হোক, তাহলে আমাদের ভাগে ভাগে সহযোগিতা করার পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন পরিকল্পনা এখনই শুরু করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হতে হবে, ইউক্রেন যেন পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে। তাহলে ইউক্রেনের বিজয়ের যে পুরস্কার, সেটা আমাদের রাজনীতিতে নতুন ও বহুমাত্রিক উপাদান যুক্ত করবে।
সৌ: প্র: আ:
ফ্যাঙ্ক লুডভিগ ব্যারিস্টার এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক সামরিক কর্মকর্তা দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct