সেইতো এলে ফিরে
আহমদ রাজু
“কেন, তোর কাছে কিছু মনে হচ্ছে না?”“তুই কি এই প্রমাণের কথা বলছিস?”“কবিতা আমার আর ভাল লাগছে না। বাদ দেতো এসব কথা। ” বিষয়টাকে অন্য দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করে রুনা। কবিতা বলল,”তুই এ কী করেছিস রুনা! মানুষ ভুল করে, তবে কারো ভুলের মাত্রা যে এত বেশি হয় তা তোকে না দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না। ”কবিতার হঠাৎ এমন ব্যবহারে হতবাক রুনা। সে বলল,”তুই কি বুঝতে পারছিস, চিঠিটা কী ইঙ্গিত করছে?”“আমার যা বোঝার বুঝেছি। তোর কি মনে আছে, একবার ঈদের দু’দিন আগে তুই হাতে মেহেদি লাগিয়েছিলি? শুকাচ্ছিল না মোটেও। এদিকে পোস্ট অফিস বন্ধের সময় হয়ে গিয়েছিল। তুই রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার বই এনে চারটি লাইন দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলি- আমি যেন তোর হয়ে সজল ভাইয়ের কাছে চিঠিটা লিখি। ”রুনার মুহূর্তে এক এক করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের কথা। এতো সেই চিঠি! এতদিন ভালবাসার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পরম যত্ন করে রেখেছিল সজল! অথচ সেই চিঠিটাকে ভুল বুঝে তাকে ফেলে গত তিন বছর এখানে রয়েছে! রাগে- লজ্জায় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না সে। কেঁদে ওঠে। কবিতা তাকে থামানোর চেষ্টা করে না। কাঁদুক- মন ভরে কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হালকা হোক সে। মেয়ের কান্না শুনে রান্না ঘর থেকে তার মা ছুটে আসে।মাকে দেখে তার কান্নার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। সে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। “আমি যে সীমাহীন ভুল করেছি মা। এ ভুল আমি কিভাবে শুধরাবো?”“কী হয়েছে মা তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?”রুনা কাঁদতে কাঁদতে বলল,”তোমার জামাইয়ের কাছে অনেকদিন আগে ওই চিঠি আমিই পাঠিয়েছিলাম। আজ মনে পড়েছে। ”“তোর চিঠি তুই চিনতে পারিসনি! তোর মতো হতভাগা আর কেউ নেই রে। ”“আমি বুঝতে পারিনি মা। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। ”“আমি তোকে বলেছিলাম, সজলের খোঁজ নে। সে এখানকার ঠিকানা জানে না। জানলে অবশ্যই চলে আসতো। ”“আমি এখন কী করবো মা? সে কী আমাকে ক্ষমা করবে?”মেয়ের কান্না দেখে মা তার নিজের চোখ সংবরণ করতে পারে না। ”চুপ কর মা। যে ভুল তুই করেছিস তার প্রায়শ্চিত্ত কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া তোকে যে ফিরে যেতে বলবো তারও উপায় নেই। সে যে এতদিনে বিয়ে করে সংসার করছে না তাইবা বুঝবো কীভাবে?”শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,”অমন কথা বলো না মা। সজল দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে না। সে আমাকে ছাড়া কাউকে কোনদিন ভাবেনি- ভাবতেই পারে না। ”“এই বিশ্বাসটার মর্যাদা তুইতো দিস নি। আমি তোকে অনেকবার বুঝিয়েছিলাম, ফিরে যা তার কাছে। তুই আমার কোন কথা তখন রাখিস নি। যখন সবকিছু বুঝলি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ”
“যতই দেরি হোক মা, সে অবশ্যই আমার আশায় পথ চেয়ে আছে। ”কবিতা এই পরিস্থিতিতে কী বলবে বুঝতে পারে না। সজল যে এতদিন বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেনি তারইবা গ্যারান্টি কী? আর বিয়ে না করলে তার মনের মাঝে যে দাগ রুনা কেটে চলে এসেছে সে দাগ ভরাট করবে কী দিয়ে? রুনাকে এখন সে গ্রহণ করবে তার ভিত্তি কী? সে আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে। ভাবনায় ছেদ পড়ে রুনার কথায়। ”কবিতা আমি এখনি যাবো সজলের কাছে। আর এক মুহূর্ত ভুলের মাত্রা বাড়াবো না। ” বলল রুনা।“ধৈর্য্য ধর রুনা। একটু খোঁজ খবর নিলে হতো না...। ”“কিসের খোঁজ খবর?” চোখ মুছতে মুছতে প্রশ্ন করে রুনা। “আসলে দিন কিন্তু অনেক পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক অনেক দেশের সরকারও পরিবর্তন হয়ে যায়। আর মন? সেতো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হতেই থাকে। ”“তুই কি বলতে চাচ্ছিস?”“বলছি, সে যে আবার বিয়ে করেনি, এ গ্যারান্টি পাচ্ছিস কোথায়? তাছাড়া এতদিন পরে সে যে তোকে গ্রহণ করবে তাই-ইবা ভাবছিস কিভাবে? তুই গেলে দূর দূর করে তাড়িয়েওতো দিতে পারে। ”একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুনা বলল,”আমার বিশ্বাস আমাকে সে ফেরাবে না। ” সে আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাগে কাপড় চোপড় ভরে যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চ ঘাটের দিকে রওনা দেয় তখন বিকাল পাঁচটা। আজ সারাদিন শ্রমিকদের দাবী আদায়ের লক্ষে লঞ্চ ধর্মঘট। লঞ্চঘাটে এসে বসে থাকে টার্মিনালে। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে রাত ন’টা বেজে যায়। সারা রাত তার ঘুম আসে না। আকাশ-পাতাল ভাবনা তার মনকে গ্রাস করে নিয়েছে। একবার ভাবছে- সজল তাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হবে। আর একবার ভাবছে- তাকে সে গ্রহণ করবে না; দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে! আবার ভাবে, যদি সে আবারো বিয়ে করেই থাকে তাহলে সতীনের সাথে থাকা কী তার পক্ষে সম্ভব? নাকি বরিশালে ফিরে যাবে? শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়, সতীনের সাথে থাকতে হলেও সে থাকবে। কারণ ভুলতো তারই। সেজন্যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তারই করতে হবে। ক্লান্তি আর অবসাদে তার চোখ বুজে আসে। সদরঘাটে যখন এসে লঞ্চ পৌঁছায় তখন সকাল সাতটা। ঢাকার রাস্তায় যানজট খুব। বিশেষ করে সকালে আর বিকেলে এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ সময় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে কখনও কখনও এক দেড় ঘন্টাও লেগে যেতে পারে। যাইহোক, সদরঘাট থেকে সাভারে পৌঁছাতে রুনার এগারোটা বেজে যায়। এই শহরের অনেককিছু পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে তৈরি হচ্ছে দালান কোঠা। যেখানে সেদিন ছিল বুক সমান পানি সেখানে এখন স্কুল ঘর-হাসপাতাল ইত্যাদি!
বুক তার দুরু দুরু। কী হয়-কী হয়! এতদিনে সজলের নিশ্চয় শহরের মত পরিবর্তন হয়েছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল টিপতেই ক্ষণেক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তার শাশুড়ী। সে রুনাকে দেখে স্বাভাবিকভাবে বলল,”বৌমা এসেছো?”রুনা হাতের ব্যাগটা নিচে রেখে শাশুড়ীর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলল,”আপনি কেমন আছেন মা?”তার শাশুড়ী মুখে উত্তর না দিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। “আমি ভুল করেছি মা। আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। ” বলে কেঁদে ওঠে রুনা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তার শাশুড়ী। ক্ষীণ স্বরে বলল,”এসো, ভিতরে এসো। ”শাশুড়ীর কথায় রুনা ব্যাগ নিয়ে ঘরের ভেতরে যায়। সে মনে মনে পুলকিত। যেহেতু শাশুড়ী তাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন তাহলে আর কোন চিন্তা নেই। রুনা ঘরের ভেতরে যেয়ে সোকেচের পাশে ব্যাগটা রেখে চারিদিকে একনজর তাকায়। না সব ঠিকঠাক আছে। কোন পরিবর্তন হয়নি। দু’এক জায়গায় মাকড়শায় জাল বুনেছে এই যা। যদি নতুন কেউ এই সংসারে আসতো তাহলে সব ঝকঝকে তকতকে থাকতো। তা নেই যখন তখন সজল বিয়ে করেনি সেটা নিশ্চিত সে। “মা, আপনার ছেলে কোথায়? অফিসে গিয়েছে নিশ্চয়। জানিনা সে আমাকে ক্ষমা করবে কি না। সে যদি আমাকে ক্ষমা না করে তাহলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। ” চোখে তার পানি, মুখে তার কান্নার স্বর। রুনার শাশুড়ী কোন কথা বলে না। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়ে ছিল; এবার সোফার ওপর যেয়ে বসে। পাশে যেয়ে বসে রুনা।“মা আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিন। সব ভুল আমার- সব দোষ আমার। ” রুনার কথার কোন উত্তর না দেওয়ায় সে আবারো বলল,”মা আপনার ছেলে কোথায় গেছে বলছেন না যে..? এখনও কী আমার ওপর রাগ করে থাকবেন?”তার শাশুড়ী আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলল,”বাইরে এসো। ” সে খাটের ওপর বিছানো তোষক উল্টিয়ে তার তলা থেকে একটা ভাঁজকরা চিরকুট নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। রুনা তার পেছন পেছন। ঘরের দক্ষিণ পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। আঙ্গুল উঁচিয়ে সামনে শিউলি তলায় নতুন একটি কবর দেখিয়ে বলল,”ঐযে, ঐ শিউলি তলায় ঘুমিয়ে আছে সজল- গভীর ঘুমে। আমার ছেলেটা তোমার জন্যে তীলে তীলে শেষ হয়ে গেল! কেন করলে তার সাথে এমন? কী ক্ষতি করেছিলাম আমরা তোমার? সেতো মৃত্যুর আগে জানতেও পারেনি তার অপরাধ কি ছিল! এই নাও, এটি তোমার জন্যে। ” বলে চিরকুটটি রুনার হাতে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে যায় সে। রুনার ইতিমধ্যে চোখ ভরে গেছে জলে। বুক তার ফেটে যায় কষ্টে-নিঃশ্বাস যেন আর চলতেই চায় না। এখন-এই মুহূর্তটা নিজের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে তার। কতটা দুঃখ-কতটা ব্যথা পেলে একটা মানুষ আর একটা মানুষের জন্যে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে পারে! সে বুঝতে পারে না তার কী এখন কাঁদা উচিৎ নাকি এখনও বেঁচে থাকা? রুনা নিশ্চুপ। কোন কথা বলে না। পিনপতন নীরবতায় সে যখন ঢলে পড়ে মাটিতে তখন কবরের নতুন মাটির সোঁদাগন্ধ নাকে আসে তার।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct