শিক্ষাজগতে এঁরা কতটা মানানসই?
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাচীন ভারতবর্ষে ছাত্ররা তাদের শিক্ষাদাতাদের গভীর শ্রদ্ধা করত। সমাজে শিক্ষাগুরুর স্থান ছিল বাবা,মায়ের মতই উঁচু। তবে শিক্ষাদানকারীরা প্রায় সবাই ছিলেন পুরুষ। কালের নিয়মে পরিবর্তনশীল এই সমাজ ব্যবস্থায় আজ বহু মহিলাও শিক্ষাদানের মত মহৎ পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। ভারতীয় সমাজে নারীদের আসন যথেষ্ট মর্যাদার। কিন্তু সবাই না হলেও,এই পেশায় যুক্ত একাধিক মহিলাকে দেখলে সেই মর্যাদার আসনকে বেশ নড়বড়ে লাগে। তাঁদের শখ,রুচি,আচার-আচরণ,চাল-চলন ইত্যাদি এই পেশার ক্ষেত্রে যেন বড়ই বেমানান। ৩৫-৩৬ বছর বয়সী একজন শিক্ষিকা অত্যন্ত জমকালো সাজ-পোশাকে একটা দামী মোবাইলে কথা বলতে বলতে তাঁর স্কুলের দিকে হাঁটছিলেন। ভাগ্যক্রমে আমি এবং আমার স্ত্রী তাঁর পিছন পিছন হাঁটছিলাম। ফোনে ঐ দিদিমনি তাঁর বরকে বলছিলেন, ‘‘ গত রাতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লে, তাই বলিনি। গত কাল সন্ধ্যায় শ্যামের মুদীর দোকানে গিয়ে দেখি,দোকানের সামনের একটা বেঞ্চে বসে, ৬-৭ টা ছেলে আড্ডা মারছে। পাশের দোকানে সাদা প্যান্ট পরা এক বুড়ো মাল কিনছিল। বেঞ্চে বসা একটা ছেলে বলল, ‘তোরা কেউ আমার ব্যাগের একটা টমেটো নিয়ে ঐ বুড়োটার সাদা প্যান্টে ছুঁড়তে পারবি?’ আরেকজন বলল, “তুই আগে কর্, তারপর আমরা করব”। প্রথমজন তখন বলল, “আমি ছুঁড়লে তো আগে তোর প্যান্টে ছুঁড়ব”। দ্বিতীয়জন বলল, “আমি নিজের কেনা প্যান্ট পরি, আর তুই তো পরিস তোর শ্বশুরের দেওয়া প্যান্ট”। অম্নি সবাই কি হাসি। এইভাবে টানা ২০ মিনিট মোবাইলে কথা বলতে বলতে তিনি স্কুলে ঢুকলেন। আর এই ২০ মিনিটই এই জাতীয় একাধিক খেলো কথা তাঁর বরকে বলে গেলেন। প্রথমত,মোবাইল কানে হাঁটা, দ্বিতীয়ত, কথার বিষয়বস্তু, দুটোই একজন শিক্ষিকায় কাছ থেকে অনভিপ্রেত। স্ত্রীর বান্ধবী এক শিক্ষিকা আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। আমার স্ত্রী তখন ছিলেননা, আমাকে ফোনে বললেন, ঐ বান্ধবী যেন বসেন। শিক্ষিকা-বান্ধবীকে বসতে দিয়ে তাঁকে দুটো খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন দিলাম। দেখলাম, ওগুলো না দেখে উনি মোবাইলে আঙুল ঘসছেন। মিনিট দশেক পর ওনাকে বললাম, ‘‘ খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলো দেখলেন না’’? ম্যাডাম বললেন, “ ওসবে কি থাকে, পলিটিক্যাল লিডারদের কচকচানি, খুন এই তো। তার চেয়ে মোবাইল দেখা ঢের ভালো। দেখুন, এই ছবিটা ফেসবুক আর হোয়াট্স্ অ্যাপে ছেড়ে,কতজন কত সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করেছে”। দেখলাম, তিনি একটা রান্না করা মুরগীর ঠ্যাং ধরে সেল্ফি তুলে হোয়াট্স্ অ্যাপ আর ফেসবুকে দিয়েছেন, তাতে নানা জন নানা কমেন্ট লিখেছেন। শিক্ষিকা মহাশয়ার ছবি নির্বাচন এবং সেটার ওপর দীর্ঘ সময় চর্চা প্রমাণ করে যে, তাঁর রুচীবোধ কত নিম্ন মানের। এটাও বুঝলাম যে, জানার আগ্রহ তাঁর নেই, তাই খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিনগুলো তিনি দেখলেন না অথচ পাঠ্যবইয়ের বাইরের ঞ্জাণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অত্যন্ত জরুরী।
আরেকদিন,আরেকজন শিক্ষিকাকে বসিয়ে আমার স্ত্রী চা এবং ডিমের অমলেট বানাতে গেলে, আমি তাঁকেও খবরের কাগজ আর দুটো ম্যাগাজিন দিয়েছিলাম। তিনিও ওগুলো না দেখে,মোবাইল ঘাঁটতে লাগলেন। তাঁর বিষয়টা ছিল একটু অন্য। কিছুদিন আগে দিল্লী গিয়ে উনি ১০-১২ টা শাড়ি আর ১০-১২ টা চুড়িদার কিনেছিলেন। সেগুলো কখনও টেবিলে, কখনও বিছানায় রেখে, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে, উনি হোয়াট্স্ অ্যাপ ও ফেসবুকে ছেড়েছিলেন। দেখছিলেন, কোন্টাতে ক’টা লাইক পড়েছে, কে কি কমেন্ট্ করেছে ? কথা প্রসঙ্গে আমার স্ত্রীকে ঐ শিক্ষিকা ম্যাম বলছিলেন, “ জিনিষের দাম যা বাড়ছে, তাতে আমাদের ডি.এ. আরও ৫-৬% বাড়া দরকার”। ভাবলাম, “ঠিকই বলেছেন, ঐ দিদিমণি। ডি.এ. বাড়লে সেই টাকায় উনি আরও কিছু কাপড়, চুড়িদার কিনতে পারবেন আর মোবাইলটাও আরেকটু দামী হবে”। আরেক দিদিমনির ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। পাঁচ বছর বিয়ে হওয়া ঐ শিক্ষিকা সেদিন বাপের বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হবার সময় তাঁর বর তাঁকে একটা বিশেষ শাড়ি পরতে বললে, শিক্ষিকা ম্যাম বললেন, “মাস ছয়েক আগে ঐ শাড়িটা পরে আমি বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এবারও ওটা পরে গেলে বাপের বাড়ির লোক আর ঐ পাড়ার মেয়ে, বৌয়েরা কি বলবে ? বলবে,মেয়েটা ভিখিরি,ওর আর শাড়ি নেই”। শিক্ষিকা ম্যাডামের বাপের বাড়ি এবং ঐ পাড়ার মানুষ কি মনে রেখেছে যে, ছয় মাস আগে তিনি কোন্ শাড়ি পরে এসেছিলেন ? তাছাড়া যদি কিছু মানুষ মনেও রাখে এবং সেটা নিয়ে মন্তব্য করে তাহলে বুঝতে হবে তারা খুব সঙ্কীর্ণমনা। তাদের গুরুত্ব দেওয়া মূর্খতা।খুঁজলে এইরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। সমাজে ভালো মানসিকতার শিক্ষিকাও আছেন। তবু এখানে যে ছবিগুলো দেখলাম, সেই জাতীয় শিক্ষিকাও কম নেই। শিক্ষাদান এমন একটি পেশা, যেখানে শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা দিতে হলে, নিজের প্রথাগত শিক্ষার বাইরে আরও জ্ঞানার্জন দরকার। কিন্তু ওপরে যেসব শিক্ষিকার ছবি দেখলাম, জ্ঞানার্জনের কণামাত্র আগ্রহ তাঁদের নেই। তাছাড়া শিক্ষাদানের পশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র গঠন করাও তো শিক্ষিকাদের একটা বড় কর্তব্য। কিন্তু নিজেদের শখ,রুচি,আচার-আচরণ,চাল-চলন ইত্যাদি যদি ঠিক না থাকে,তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র গঠন তাঁরা কিভাবে করবেন?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct