জাতিসংঘের গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যা ইতিমধ্যে ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে দেশ হিসেবে চীনে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস। তবে গত ১৫ এপ্রিল জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বার্ষিক প্রতিবেদনের হিসাবমতে, এখন ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। লিখেছেন মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।
তিসংঘের গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যা ইতিমধ্যে ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে দেশ হিসেবে চীনে ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস। তবে গত ১৫ এপ্রিল জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বার্ষিক প্রতিবেদনের হিসাবমতে, এখন ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। শীর্ষ জনসংখ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় দেশ হিসেবে চীন ও ভারতে যৌথভাবে বিশ্বের ৩৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৪২ কোটি ৬ লাখ। অন্যদিকে ভারতের ছিল ১৪১ কোটি ২ লাখ। গত এপ্রিলে ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিশ্ব গণমাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়। ভারত চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পর এই দুই দেশ বা বাকি বিশ্বে এর কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। ইউএনএফপিএর সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ৪৫ লাখ। শীর্ষ জনসংখ্যার দেশ ভারতে এখন জনসংখ্যা প্রায় ১৪২ কোটি ৮৬ লাখ। আর পরের অবস্থানে থাকা চীনে রয়েছে প্রায় ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালেও ভারত ও চীনের অবস্থান প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানেই থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। তবে জনসংখ্যার আকার ভিন্ন মাত্রা পাবে। ওই সময় ভারতের জনসংখ্যা হবে প্রায় ১৬৬ কোটি ৮ লাখ এবং চীনের কমে হবে প্রায় ১৩১ কোটি ৭ লাখ। ভারত ও চীনের পর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ (২০২২) হিসাবে এই দেশের জনসংখ্যা ৩৩ কোটি ৭০ লাখ এবং ২০৫০ সালে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ।
বিশ্বের জনবহুল অন্যান্য দেশের চিত্র
বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যার তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (২৭ কোটি ৫০ লাখ), পঞ্চম অবস্থানে পাকিস্তান (২৩ কোটি ৪০ লাখ)। নাইজেরিয়া রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। এই দেশের জনসংখ্যা ২১ কোটি ৬০ লাখ। এ ছাড়া সপ্তম স্থানে আছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল (২১ কোটি ৫০ লাখ)। ১৯৯০ সালে বিশ্বে শীর্ষ ১০ জনসংখ্যার তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৪ কোটি ৮০ লাখ)। আর জাপান ছিল সপ্তম স্থানে (১২ কোটি ৩০ লাখ)। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় বর্তমানে রাশিয়ার অবস্থান নবম (১৪ কোটি ৫০ লাখ)। একইভাবে পিছিয়ে জাপানের অবস্থান এখন ১১তম (১২ কোটি ৪০ লাখ)। ইউএনএফপিএর পূর্বাভাস বলছে, ২০৫০ সালে রাশিয়ার জনসংখ্যা কমে ১৩ কোটি ৩০ লাখ হবে। তখন তার অবস্থান হবে ১৫তম। দক্ষিণ আমেরিকার আরেক দেশ মেক্সিকোর বর্তমান অবস্থান দশম (জনসংখ্যা ১২ কোটি ৭০ লাখ)। ২০৫০ সালে তাদের অবস্থান নেমে ঠেকবে ১৩তমে (জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৪০ লাখ)। আর বর্তমান অষ্টম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩০ লাখ। তবে ২০৫০ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ২০ কোটি ৪০ লাখ হলেও জনসংখ্যার ভিত্তিতে অবস্থান হবে দশম।
দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা
১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। ২০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১২৩ বছর (১৯২৭ সাল)। এরপর থেকে দ্রুতই বাড়তে থাকে বিশ্বের জনসংখ্যা। ৩২ বছর পর ১৯৫৯ সালে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ কোটিতে। এরপর ৪০০ কোটির মাইলফলক স্পর্শ করতে সময় লাগে মাত্র ১৫ বছর। ১৯৭৪ সালে ৪০০ কোটি পার হওয়ার পর এই বৃদ্ধির হার আরও ত্বরান্বিত হতে থাকে। ১৯৭৪ সালের পর প্রতি ১২-১৩ বছরে ১০০ কোটি করে বেড়েছে বিশ্বের জনসংখ্যা। ১৯৮৭ সালে ৫০০ কোটি, ১৯৯৮ সালে ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ৭০০ কোটি আর ২০২২ সালে ৮০০ কোটিতে দাঁড়ায় এই সংখ্যা। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৯০৭ কোটি। আর ২১০০ সালে ১ হাজার ৪০ কোটির ম্যাজিক সংখ্যা স্পর্শ করবে।
কেন বিশ্ব জনসংখ্যায় বা দেশভিত্তিক পরিবর্তন ঘটছে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জনসংখ্যায় কেউ এগিয়ে যাচ্ছে, কেউবা পিছিয়ে যাচ্ছে। যেমনটি দেখা গেল ভারত-চীনের ক্ষেত্রে। বিষয়টিকে জনমিতিক প্রক্রিয়ার (জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর) মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। জনমিতিক পরিবর্তন মডেল (ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন মডেল) অনুযায়ী, জন্ম ও মৃত্যুহার এখানে মুখ্য ভূমিকা রাখে। জন্মহার ও মৃত্যুহারের হ্রাসবৃদ্ধির কারণে কোনো দেশের জনসংখ্যার আকার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তারতম্য ঘটে থাকে। ফলে কোনো দেশে উচ্চ প্রজনন হার থাকলে, সে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি থাকে। আগেই বলা হয়েছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। যেমন নাইজেরিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া। ২০৫০ সাল নাগাদ এসব দেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় চলে আসবে। বর্তমানে ভারতের তুলনায় চীনের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও মোট প্রজনন হার (টিএফআর) বেশ কম। ফলে ভারতের জনসংখ্যার আকার বাড়ছে। এতেই ভারত হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। বিশ্বের জন্য বার্তা কী বিশ্বে জনসংখ্যার আকার বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে এই বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় বেশ কম। ২০১৯ সাল থেকে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হারে দেশ ও অঞ্চলভেদে তাৎপর্যপূর্ণ তারতম্য আছে। ২০৫০ সালে সাব-সাহারান আফ্রিকার জনসংখ্যা বর্তমানের দ্বিগুণ হবে। এর অর্থ, সেখানে প্রজনন হার আগের মতোই থাকবে। অন্যদিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় মোট জনসংখ্যা বাড়বে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এসব বিষয় মাথায় রাখলে জনসংখ্যা নিয়ে কিছু বার্তা পাওয়া যায়।
প্রথমত: বিশ্বব্যাপী প্রজনন ও মৃত্যুহারের মাত্রা ও নিদর্শনে তারতম্য রয়েছে। যেমন বৈশ্বিকভাবে মোট প্রজনন হার ধারাবাহিকভাবে প্রতি নারীতে কমে এসেছে ২ দশমিক ৩টি সন্তানে। বর্তমানে নারীরা সার্বিকভাবে কম সন্তান নিলেও কিছু কিছু অঞ্চলে (সাব-সাহারান আফ্রিকা, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়া) প্রজনন হার অনেক বেশি।
দ্বিতীয়ত: জনসংখ্যার আকার ও পুরো জনসংখ্যার মধ্যে বয়স্ক (৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব) জনসংখ্যা বাড়ছে। ২০২০ সালে এ জনগোষ্ঠী ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০৫০ সালে হবে ১৬ শতাংশ। তখন পৃথিবীর প্রতি ছয়জন মানুষের একজন হবে বয়স্ক জনগোষ্ঠী (৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব)।
তৃতীয়ত: ধারাবাহিক প্রজনন হার হ্রাসে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়ছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি করছে, যা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ নামে পরিচিত।
চতুর্থত: ক্রমান্বয়ে দেশের পর দেশে জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী লক্ষ করা যায়, ২০২২-৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৬১টি দেশে কমপক্ষে ১ শতাংশ জনসংখ্যা কমতে থাকবে। গত কয়েক দশকে অনেক দেশেই মোট প্রজনন হার কমে এসেছে। পঞ্চমত: আন্তর্জাতিক অভিবাসনের কারণে কিছু দেশের জনসংখ্যা ক্রমধারায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশ থেকে মানুষ ভালো জীবনের আশায় উচ্চ আয়ের দেশে কাজের বা শ্রমবাজারে কাজ নিচ্ছেন, অভিবাসী হচ্ছেন।
ষষ্ঠত: কোভিড-১৯ মহামারি জনসংখ্যা পরিবর্তনের তিনটি উপাদানে (জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর) প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী আয়ুষ্কাল ২০১৯ সালে যেখানে ছিল ৭২ দশমিক ৮ বছর, তা ২০২১ সালে কমে ৭১ বছরে নেমে এসেছে।
সপ্তমত: উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনসংখ্যার গুণগত উপাত্ত দিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। এ ক্ষেত্রে গুণগত জনসংখ্যার প্রাক্কলন ও প্রক্ষেপণ নির্ভর করে নির্ভরযোগ্য, সময়মতো জনমিতিক উপাত্ত—যেমন জনশুমারি, স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, গৃহস্থালি জরিপ। ওপরের এসব বার্তাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশ, অঞ্চল বা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নীতি ও কৌশলের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। বর্তমানে বিশ্ব জনসংখ্যা ৮০০ কোটির অর্থ ৮০০ কোটি শক্তি। বড় সংখ্যা, বড় চ্যালেঞ্জ ও বড় সম্ভাবনা। বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়লেও কোনো দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, আবার কোনো দেশে কমছে। এ নিয়ে আশঙ্কা বা দুশ্চিন্তা না করে একে দেখতে হবে প্রগতি ও উন্নতির প্রতীক হিসেবে, ব্যক্তিগত অধিকার ও পছন্দকে বেছে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে।
সৌ: প্র: আ: মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct