সেইতো এলে ফিরে
আহমদ রাজু
“তোর কোথাও ভুল হচ্ছে হয়তো...।”“আমার কোন ভুল নেই। আমি হাতে নাতে প্রমাণ পেয়েছি।”মা শান্ত না দেয় মেয়েকে।”থাম মা থাম। তোর আর কী করার আছে বল। নিয়তি ভেবে সব মেনে নে। এ তোর কপালে লেখা ছিল। তা না হলে তুই নিজেই কেন তাকে পছন্দ করে বিয়ে করবি। আর কেনইবা এত বছর পরে সেখান থেকে ফিরে আসবি?”রুনার হঠাৎ অন্তর্ধানে সজল নিজেকে সামলাতে পারে না। সে ভেঙে পড়ে খুব। দিন যত গড়াতে থাকে শরীর তার ততই খারাপের দিকে ধাবিত হয়। তার মা-বাবা আর ছোট দুই ভাই মীরপুরে থাকলেও অফিসের কাছে থাকার জন্যে বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে সজল থাকতো সাভারে। এখানে বাড়িটা পরে সে নিজেই কিনেছিল। সজলের শরীর খারাপ জানতে পেরে তারা সাভারে এসেছে। সেবা-যত্ন করে সজলকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাজ হয় না। দিন যতই পার হয় ততই তার শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হয়েই চলেছে। শেষপর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। কি এক অদৃশ্য কারণে তার শরীর শুকিয়ে শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছে। এ টেস্ট সে টেস্ট করে অসুখ ধরা পড়ে না। শরীরের হাড়গুলো সব এক নিমেষে গুনে শেষ করা যায় এখন। হৃদযন্ত্র টিনটিন করে চললেও মনে তার ভাবনা আকাশ কুসুম। সে ভাবনা রুনাকে নিয়ে। এতদিনে ভাবনার গতিতে একটুও ভাটা পড়েনি। কেন কী কারণে কিসের মোহে তাকে সে ছেড়ে গেল? কোন অপরাধেইবা এই অকূল পাথারে ভাসিয়ে দিয়ে নিজে সুখের সাম্পানে ভেসে বেড়াচ্ছে? এখন সে কেমন আছে? নাকি ভুলের অনুতপ্তে দহন জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছে নিরবধি? কোন সদুত্তর নেই সজলের কাছে। সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে আর তার দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে নীরবে। পাশে বসে থাকা মায়ের চোখ যা এড়ায় না। সে সজলের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,”অত চিন্তা করিস কেন বাপ? তোকে ছেড়ে যদি সে ভাল থাকে তাহলে তুই কেন ভাল থাকবি না? একটা স্বার্থপর মানুষের জন্যে তুই কেন নিজেকে শেষ করছিস তিলে তিলে? আগে সুস্থ হয়ে ওঠ তারপর আমরা রুনার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে দেখে তোকে আবার বিয়ে দেবো।”সজল মায়ের কথার কোন উত্তর দেয় না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। “একটু বোঝার চেষ্টা কর, এতদিন যে ফিরে আসেনি, তোর একবারও খোঁজ দেয়নি, তার জন্যে কেন নিজেকে শেষ করছিস? তুই কিছু কী বুঝিস না? তোর জন্যে- তোর সাথে আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি!” ছেলের মাথায়-কপালে হাত বোলায় মা। সজলের কথা বলতে ইদানীং কষ্ট হয় খুব। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,”আমি জানি মা, তোমরা সবাই আমার জন্যে কত কষ্ট করছো। আমিতো ভাল আছি মা। আমাকে এখানে কেন রেখেছো?”ছেলের মাথাটা আলতো করে নিজের কোলের উপর নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,”তুই বাড়ি ফেরার মত এখনও হসনি। ডাক্তার বলেছে, আরো কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।”“তোমরা আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো। আমার এখানে মোটেও ভাল লাগছে না।”“তুই দুশ্চিন্তা বাদ দে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সজল। বলল,”আচ্ছা মা; বলতে পারো, মানুষ মানুষকে এভাবে ভুলে যায় কী করে?”“চুপ কর; একটু চুপ কর।” বলে ছেলের মুখে- মাথায় হাত বোলায় তার মা। “কেন চুপ করবো মা? কেউ যদি এভাবে চলে যেতে পারে আমি কেন বলতে পারবো না?” চোখ বেয়ে তার অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে নিচে। ছেলেকে অসুস্থ দেখে মায়ের মনের অবস্থা যে কেমন তা একজন মা-ই বুঝতে পারে। ছেলেকে নিজের সামনে এভাবে কষ্ট পেতে দেখেও কিছু করতে পারে না সে। ডাক্তার অবশ্য বলেছে, দুশ্চিন্তামুক্ত হলেই সে ভাল হতে পারে নতুবা সামনে তার কঠিন সময়। তাইতো ছেলেকে সে সময়-অসময় বিগত অতীতকে ভুলিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করে যা সম্ভব হয় না বুঝতে পারে সজলের মা। কবিতা স্বামীর সাথে ইতালী চলে গিয়েছিল বিয়ের তিন মাসের ভেতর। বিয়ের দিনই তার সাথে শেষ দেখা রুনার। আজ এত বছর পর সে নিজের দেশে- নিজের বাবার বাড়িতে এসেছে। এসেই যখন শুনেছে রুনা এখানে আছে সে আর দেরি করেনি; সোজা রুনাদের বাড়ি উপস্থিত। পুরোনো সেই সইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে কবিতা। তবে সে মনে মনে যতটা আনন্দ পেয়েছে ঠিক ততটাই দুঃখ পায় রুনার মুখ দেখে-শরীরের অবস্থা দেখে।”এ কী অবস্থা হয়েছে তোর!” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল কবিতা। রুনা মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,”আমার কথা বাদ দে; তুই কেমন আছিস?”“আমি তো বেশ ছিলাম। কিন্তু তোকে দেখার পরে কেন যেন সেই ভালটা উবে গেছে।”“কেনরে আমার আবার কি হলো?”“তুই সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?”“না; কিছু হয়নি। চল ঘরে চল।” বলে কবিতার হাত ধরে রুনা ঘরের ভেতরে নিয়ে খাটের ওপর বসায়।“আচ্ছা সজল ভাইয়ের সাথে তোর কি কিছু হয়েছে?”
রুনা নিশ্চুপ, কোন কথা বলে না। রুনাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে কবিতা বলল,”কী রে, কিছু বললি না যে..”ক্ষণেক আনমনা হয়ে গিয়েছিল রুনা। সঞ্চিৎ ফিরে পায় সে। বলল,”আছে।”“আছে মানে? আমি কি বলেছি তুই কি বুঝতে পেরেছিস?”রুনা আসলে কবিতার কথা খেয়াল করেনি। তাইতো বলল,”আবার বল।”“বলছি সজল ভাইয়ের সাথে কি কিছু হয়েছে? আর ছেলে-মেয়ে.....”কবিতার কথা শেষ করতে না দিয়ে রুনা বলল,”আমি তিন বছর হলো সজলের ওখান থেকে চলে এসেছি।”বিস্মিত কবিতা। বলল,”কেন?”“সে অনেক কথা।”“ছেলে-মেয়ে?”“নারে হয়নি।”“কী বলিস!”“ডাক্তার-কবিরাজ কম দেখাইনি। কিছুতেই কিছু হয়নি।”“শুনেছিলাম আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই নাকি তোর বিয়ে হয়েছিল?”“তুই ঠিকই শুনেছিলি।”“তাহলেতো প্রায় পনের বছর হতে চললো।”“হু; ওই রকম।”“তাহলে এতদিন পর কী এমন হলো যে, একেবারে ছেড়ে চলে এলি? নাকি সে নিজেই তোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করেছে?”“না, তা করেনি। আমি নিজেই এসেছি। ভেবে দেখলাম, আর যাই হোক কোন চরিত্রহীন মানুষের সাথে সংসার করা সম্ভব নয়।”বিস্ময় প্রকাশ করে কবিতা। বলল,”বলিস কী! সজল ভাইয়ার চরিত্রে সমস্যা! আমি দেখলেও বিশ্বাস করবো না।”“আমিও তাকে দেবতার মত বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সেদিন আমি যে প্রমাণ হাতে পেয়েছিলাম তাতে বিগত দিনগুলির সমস্ত বিশ্বাস আমার ধুলির সাথে মিশে গিয়েছিল।”“সে তোকে আটকানোর চেষ্টা করেনি।”“আমি তো তাকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম।”“পরে তোকে কোনদিন নিতে আসেনি?”“আসবে কীভাবে? এখানকার ঠিকানাতো সে জানেই না।”“আমার মনে হয় তোর কোন একটা ভুল হয়েছে। আসলে বিয়ের আগে সজল ভাই সম্পর্কে তোর মুখে যত কথা শুনেছি তাতে আমার মনের ভেতরে সে দেবতা হয়ে আসন গেড়ে আছে আজো। আর তুই তার সাথে বারো বছর সংসার করেও চিনতে পারিসনি মনে হচ্ছে। রাগান্বিত হয়ে ওঠে রুনা। বলল,”চিনতে পারিনি তাই না। অপেক্ষা কর, তোকে প্রমাণ দেখাচ্ছি।” বলে খাট থেকে উঠে সোকেচের ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা হলুদ খাম বের করে কবিতার হাতে দিয়ে বলল,”এই দ্যাখ, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আমার আর কী কিছু দরকার আছে?”কবিতা খামটা হাতে নিয়ে প্রাপকের ঠিকানার ওপর চোখ ফেলতেই চমকে ওঠে। এ যে তারই হাতের লেখা! সে তড়িঘড়ি ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে সামনে মেলে ধরে। তার মনে পড়ে যায় ষোল/সতের বছর আগে ফেলে আসা এক ঈদের এক সপ্তাহ আগের কথা। রুনা হাতে মেহেদী লাগিয়েছিল। এদিকে পোস্ট অফিসে সেদিন চিঠি পোস্ট না করলে ঈদের আগে প্রাপকের কাছে পৌছাবে না। তখন রুনা কবিতাকে বলেছিল তার হয়ে যেন একটা চিঠি সজলকে লেখে। তাইতো রুনার কথামত কবিগুরুর শেষের কবিতার চারটি লাইন লিখে খামে ভরে পোস্ট করেছিল- “যে আমারে দেখিবার পায়অসীম ক্ষমায়ভালো মন্দ মিয়ায়ে সকলি, এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি”“এই কী তোর সেই প্রমাণ?” রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল কবিতা।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct