ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হুসাইন হাসিম আনসারী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি জাতীয়তাবাদের ধারণাকে পরিপুষ্ট করেছেন। সাধারণত জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা যা বুঝি তা হল নিজের জাতিকে ভালোবাসা বা দেশের সার্বিক বিকাশ সাধনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালানো ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদ বলতে পৃথক রাষ্ট্র গঠন, সমগ্র বিশ্ব থেকে নিজ জাতিকে পৃথক করে নেওয়া, বিভিন্ন জাতি, ভাষা ও ধর্মের মধ্যে বিবাদ প্রভৃতিকে বোঝায় তাহলে সেই জাতীয়তাবাদকে তিনি কোন প্রকারেই সমর্থন করেননি। তিনি মনে করতেন পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল অন্তর্দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। তবে একথাও দৃঢ় সত্য যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। দেশবাসীর মধ্যে সুপ্ত আত্মশক্তিকে বিকাশের জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। যে সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদের উগ্র কামনায় হিংসা ও দেশ দখলে মেতে উঠেছিল, সেসময় রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মানবজাতির ঐক্য চেতনার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল, মানবজাতির আত্মিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদ-সম্পর্কিত ধারণায় নিজের জাতির মধ্যে সকল জাতির এবং সকল জাতির মধ্যে নিজের জাতির সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন জাতীয়তাবাদের মধ্যে যে অন্ধ দেশভক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত আছে তা মানুষকে নেশার মত আচ্ছন্ন করে মানুষের শুভ বুদ্ধিকে বিনষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদী ধারণার দ্বারা চালিত হলে মানুষের স্বাধীন বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয় ও মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। যা মানুষের জাতীয় পরিমার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে মানবসভ্যতায় সংকট সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদ তখন সাহাজ্যবাদে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করেন। জাতীয়তাবাদের দ্বারা শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ অধিকতর দুর্বল রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ চালায় ও অবশেষে ধ্বংস করে ফেলে। ফলে একটি জাতি অন্য জাতির কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, পশ্চিমি জাতীয়তাবাদ— কখনোই ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মেলালে চলবে না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ন্যাশনালিজম গ্রন্থের প্রথমেই এই কথাটি বলেছেন”Our REAL PROBLEM in India is not political. It is social.” ভারতের ‘জাতি’ সম্পর্কিত সমস্যা থাকলেও তা রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না, ভারতের সামাজিক ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তাই কোন জাতি ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন যে ‘নেশন’ বা ‘ন্যাশনালিজম’-এর উগ্র উন্মাদনার দানবীয় রূপ কখনও ভারতের কাম্য হতে পারবে না। ভারতের কাম্য হল মহোত্তম মানবিক ও আধ্যাত্মিক ঐক্যে উদ্বুদ্ধ এক বিশ্বজনীন আদর্শের দেশ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct