আজ কর্ণাটকে ২২৪ আসনবিশিষ্ট বিধানসভার ভোট। ১৩ মে ফলাফল ঘোষণা। বিজেপির বিজয়রথ রুখে কংগ্রেস রাজনীতি জমিয়ে দেবে, নাকি ম্যাজিশিয়ান মোদি শেষ প্রহরের কিস্তিমাতে চওড়া হাসি হাসবেন—এ নিয়ে চলছে জল্পনা। তৃতীয় সম্ভাবনাও যে নেই, তা নয়। ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) নির্ণায়কের ভূমিকায় এসে গেলে রাজ্য রাজনীতিতে দেবগৌড়া-কুমারস্বামীর প্রাসঙ্গিকতা আরও কিছুকাল টিকে থাকবে। সর্বত্র কী হয় কী হয় জল্পনা। লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতের মণিপুর রাজ্যে সহিংসতা চলছে। সহিংসতার আগুন ছড়িয়েছে মেঘালয়েও। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের খুব যে মাথাব্যথা, এটি বোঝার উপায় নেই। কেননা কেন্দ্র কিছুদিন যাবৎ কেন্দ্রীভূত কর্ণাটকে। দক্ষিণের এই রাজ্য ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিনরাত এক করে দিয়েছেন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জ্বলা-নেভা তাই অকিঞ্চিৎকর। আজ ২২৪ আসনবিশিষ্ট রাজ্য বিধানসভার ভোট। ১৩ মে ফলাফল ঘোষণা। বিজেপির বিজয়রথ রুখে কংগ্রেস রাজনীতি জমিয়ে দেবে, নাকি ম্যাজিশিয়ান মোদি শেষ প্রহরের কিস্তিমাতে চওড়া হাসি হাসবেন—এ নিয়ে চলছে জল্পনা। তৃতীয় সম্ভাবনাও যে নেই, তা নয়। ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় ধর্মনিরপেক্ষ জনতা দল (জেডিএস) নির্ণায়কের ভূমিকায় এসে গেলে রাজ্য রাজনীতিতে দেবগৌড়া-কুমারস্বামীর প্রাসঙ্গিকতা আরও কিছুকাল টিকে থাকবে। সর্বত্র কী হয় কী হয় জল্পনা।
কর্ণাটকের গুরুত্ব : অর্থনীতির সিঁড়িতে কর্ণাটকের স্থান তৃতীয়। মহারাষ্ট্র (৩৫.২৭) ও তামিলনাড়ুর (২৪.৮৫) পর কর্ণাটকের মোট বার্ষিক উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। ২৩ দশমিক ৩৪ লাখ কোটি টাকা। দেশের মোট প্রবৃদ্ধির প্রায় ১০ শতাংশ এই রাজ্যের অবদান। এমন এক রাজ্যের ক্ষমতা দখল আজকের দিনে নানা কারণে অর্থবহ। শাসক বিজেপির কাছে এটা দাক্ষিণাত্যের সদর। কর্ণাটক ধরে রাখলে অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে প্রভাব বিস্তার সহজতর হবে। এত বছর ধরে এ রাজ্যে বিজেপির লালন ও বিকাশ ঘটিয়েছেন বি এস ইয়েদুরাপ্পা। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে রাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের এই অবিসংবাদিত নেতা এত বছর ছিলেন বিজেপির চালক। তাঁর ভাবমূর্তি ও প্রভাবের কাছে স্তিমিত সবাই—অটল বিহারি বাজপেয়ীও।
১০৪ : কর্ণাটকে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জেতে ১০৪ আসন, ভোট পায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ। কংগ্রেস প্রায় ২ শতাংশ বেশি ভোট টেনেও আসন জেতে ৮০টি। ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জেডিএস জেতে ৩৭ আসন কিন্তু ক্রমে কোণঠাসা ইয়েদুরাপ্পা বাধ্য হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে বানপ্রস্থে যেতে। মোদি–জমানায় আদভানি-যোশির মতো ‘মার্গদর্শক’। ইয়েদুরাপ্পার পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি এবার কাউকে খাড়া করেনি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্বাইও লিঙ্গায়েত। কিন্তু ভাবমূর্তি প্রবল কলুষিত। কর্ণাটকে ‘কান্ডারিহীন’ বিজেপির অগতির গতি নরেন্দ্র মোদিই। মোদি ছাড়া বিজেপির নির্ভরতা এক–চতুর্থাংশ নতুন প্রার্থী। বাদ পড়েছেন ৩০ জনের মতো বিধায়ক। তাতে সমস্যা বেড়েছে লিঙ্গায়েত সমাজে। ইয়েদুরাপ্পার ‘অবসরে’ লিঙ্গায়েত সমাজ ক্ষুব্ধ। টিকিট না পেয়ে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার ও উপমুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মণ সাভাডি কংগ্রেসে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনী জনসভায় তাঁদের অভিযোগ, বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত বি এল সন্তোষ, প্রহ্লাদ যোশিরা ব্রাহ্মণদের ক্ষমতাসীন করতে চাইছেন। লিঙ্গায়েত সমাজ বিজেপির প্রধান শক্তি। সেই খুঁটি নড়ে গেলে ভরাডুবি অসম্ভব নয়।
কংগ্রেসের শক্তি ও দুর্বলতা : জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের হাল যতটা নড়বড়ে, এ রাজ্যে ততটাই পোক্ত। কর্ণাটকে নেতাহীনতা বিজেপির সমস্যা, কংগ্রেসের সমস্যা নেতার প্রাচুর্য। অনগ্রসর কুড়ুবা সম্প্রদায়ের নেতা সিদ্দারামাইয়ার ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও দুর্নীতির কালি মাখেননি। অসম্ভব ভালো বক্তা এবং জননেতা বলতে যা বোঝায়, সিদ্দারামাইয়া তেমনই। সব মহলেই জনপ্রিয়। এটা তাঁর শেষ নির্বাচন জানিয়ে দিয়েছেন। ৭৬ বছরের সিদ্দারামাইয়ার পাশাপাশি রয়েছেন ৬০ বছরের ডি কে শিবকুমার। রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাবান ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের এই নেতা সম্পদ ও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রবল শক্তিধর। দলের সংকটে সব সময় বুক আগলে দাঁড়িয়েছেন। তাই হাইকমান্ডের স্নেহধন্য। ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেডিএসের দেবগৌড়া ও তাঁর ছেলে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর প্রশ্নহীন প্রভাবের মধ্যে কংগ্রেসের ফুল ফুটিয়েছেন শিবকুমারই। তবে সিদ্দারামাইয়ার মতো দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছতার প্রতীক তিনি নন। এই দুজনের মাঝে মধ্যমণি হয়ে জ্বলজ্বল করছেন ‘দলিত’ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। বিজেপির লিঙ্গায়েত–নির্ভরতার তুলনায় কংগ্রেসের প্রভাব ভোক্কালিগা, অনগ্রসর, দলিত ও মুসলমানদের মধ্যে ছড়ানো। এ কারণে কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার বিজেপির চেয়ে বেশি হলেও আসনসংখ্যায় বিজেপি ২০১৮ সালে কংগ্রেসকে টপকে গিয়েছিল। ভারতে অর্থনীতির সিঁড়িতে কর্ণাটকের স্থান তৃতীয়। মহারাষ্ট্র (৩৫.২৭) ও তামিলনাড়ুর (২৪.৮৫) পর কর্ণাটকের মোট বার্ষিক উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। ২৩ দশমিক ৩৪ লাখ কোটি টাকা। দেশের মোট প্রবৃদ্ধির প্রায় ১০ শতাংশ এই রাজ্যের অবদান। এত শক্তিশালী হয়েও কংগ্রেসের দুর্বলতা তারা নিজেই। নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে কীভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়, কংগ্রেস তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। টাটকা নমুনা উত্তরাঞ্চল ও পাঞ্জাবের হার। সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমারের দ্বন্দ্বও অনেক সময় লোকসানের কারণ হয়েছে। এবার মুখ্যমন্ত্রিত্বের জোরালো দাবিদার দুজনই। ফলে দলে চোরাস্রোত বহমান। শেষ নির্বাচনী জয় সিদ্দারামাইয়া মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উদ্যাপনে আগ্রহী। শিবকুমার অপেক্ষায় থাকতে রাজি নন। কে কতজন বিধায়ককে জেতাতে পারবেন, তার ওপরেই নির্ভর করবে মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন। তাতে সমাধান না হলে তুরুপের তাস হিসেবে থাকছেন অজাতশত্রু খাড়গে—তিন–তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এলেও যিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
‘ডাবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব বনাম জনমুখী প্রতিশ্রুতি : সব জায়গার মতো কর্ণাটকেও বিজেপি ‘ডাবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব দিয়ে প্রচার শুরু করেছিল। কিন্তু শুরুতেই তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, সাড়ে তিন বছরের যাবতীয় উন্নয়ন ভেসে গেছে দুর্নীতির তোড়ে। রাজ্যের ঠিকাদারদের সংগঠন, স্কুলের প্রশাসনিক কমিটি ঘুষের বিরুদ্ধে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ জানিয়েছে। ভণিতাহীনভাবে বলেছে, সরকারি বরাত, নিযুক্তি ও প্রকল্প পেতে গেলে ৪০ শতাংশ ঘুষ দিতে হচ্ছে।কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে পঞ্চায়েতরাজমন্ত্রী কে এস ঈশ্বরাপ্পার বিরুদ্ধে এক ঠিকাদার এমনই ঘুষের অভিযোগ আনেন। পরে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে তিনি সরাসরি মন্ত্রীকে দায়ী করে গিয়েছেন। ঈশ্বরাপ্পাকে পদত্যাগ করতে হয়। ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েন শাসক দলের এক বিধায়কের ছেলেও। সরকারি কর্তা হয়েও বাবার অফিসে বসে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিচ্ছিলেন। বাপ-ছেলের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে সাত কোটি টাকা। কংগ্রেসের প্রচারে এই দুর্নীতির পোশাকি নাম ‘পেসিএম’। তাদের স্লোগান, ‘৪০ শতাংশ সরকার, বিজেপি মানে ভ্রষ্টাচার’। বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ হলো ডাবল চুরি। দ্বিগুণ অপশাসন। অসহায় বিজেপি তাই প্রচারের অভিমুখ বারবার পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে। উন্নয়নের ফিরিস্তিতে কাজ না হওয়ায় তারা প্রথমে আঁকড়ে ধরে ধর্মীয় মেরুকরণকে। ভিলেন খাড়া করে টিপু সুলতানকে। হিজাব, আজান, আমিষ আহারকে অস্ত্র করে। মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট ৪ শতাংশ কোটা তুলে দিয়ে হিন্দুদের মন জয়ের চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে কংগ্রেস সভাপতি ‘বিষধর সাপ’ বলেছেন—এ অভিযোগ এনে মোদির ফিরিস্তি, কংগ্রেস তাঁকে ৯১ বার অসম্মান করেছে। তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন, বিজেপি নেতারাও সোনিয়াকে ‘বিষকন্যা’ বলেছেন। রাহুল-প্রিয়াঙ্কা পাল্টা রাজনৈতিক জবাব দেওয়ায় বিজেপির প্রচারের অভিমুখ আবার বদলে যায়। তাদের সর্বশেষ হাতিয়ার বজরঙ্গ দল নিষিদ্ধ করার কংগ্রেসি প্রতিশ্রুতি। মোদি-শাহ এখন ভাষণ শেষ করছেন ‘জয় বজরঙ্গবলি’ স্লোগান দিয়ে। হনুমান মন্দিরে শীর্ষস্থানীয় নেতারা পাঠ করছেন ‘হনুমান চালিশা’।
সৌজন্যে: প্র: আ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct