ইউক্রেনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাপারোভার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরটি কেমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আপনি কাকে এই প্রশ্ন করেছেন। ভারতের বিবৃতি অনুযায়ী, এ সফরটি ছিল সরকারি পর্যায়ে নিয়মিত সফর। আর ইউক্রন সরকারের ভাষ্য হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের জন্য কঠিন এক বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর কোনোটিই সত্য নয়। গত বছরে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করার পর এই প্রথম ইউক্রেনীয় কোনো মন্ত্রী ভারতে এলেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারত একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। লিখেছেন ফয়সাল আল ইয়াফি।
ইউক্রেনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাপারোভার সাম্প্রতিক দিল্লি সফরটি কেমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আপনি কাকে এই প্রশ্ন করেছেন। ভারতের বিবৃতি অনুযায়ী, এ সফরটি ছিল সরকারি পর্যায়ে নিয়মিত সফর। আর ইউক্রন সরকারের ভাষ্য হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের জন্য কঠিন এক বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর কোনোটিই সত্য নয়। গত বছরে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন শুরু করার পর এই প্রথম ইউক্রেনীয় কোনো মন্ত্রী ভারতে এলেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ভারত একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। পশ্চিমের সমালোচনা না করেই তারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ইউরোপের বাজার শীতলতা দেখালেও ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বাড়িয়েছে। গত শরৎকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকাল ঘোষণা দেন, তাদের বন্ধুত্ব ‘অভঙ্গুর’। এ ছাড়া মোদি ইউক্রেন সম্পর্কে খুব কমই বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে, গত বছর ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে কিন্তু কিছুর বাইরে কদাচিৎ কিছু বলেছে। এ বছর ভারত জি-২০ সম্মেলনের আয়োজক দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর জোটটির শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে সংলাপের দ্বার খুলে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। গত মাসে অনুষ্ঠিত হয় জি-২০ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের উপস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি তাঁর সূচনা ভাষণে ইউক্রেনের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। কিন্তু সমাপনী ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে দেশগুলোর মধ্যে অনেক বেশি ‘বিভেদ’ আছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে, জি-২০-এর সম্মেলনটি যৌথ বিবৃতি ছাড়াই শেষ হয়।
ভারতের বিষয়টা বিবেচনা করা হলে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকেই ঐতিহাসিকভাবে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী দেশ তারা। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান সেই ইতিহাসেরই অনুরণন। এখানে একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। চীন যখন ক্রমাগত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সে সময় ভারতের নিরপেক্ষ দেশগুলোর নেতা হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই নিরপেক্ষ অবস্থান ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাব ফেলছে। এটা এক বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে ভারতের অবস্থান, কোনো একটা পক্ষে গিয়ে অন্য পক্ষের ঝড় তারা এড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের বিষয়টা শুধু পক্ষ বাছাইয়ের মতো একটা বিষয় নয়। এটা বরং ভারতের সামনে দুটি বিকল্প সামনে নিয়ে এসেছে, যার একটিকে বেছে নিতে হবে। এক, এটি একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ বাকি বিশ্বের তাতে তেমন কিছু করার নেই; অথবা দুই, এটা সেই যুদ্ধ যেখানে সব দেশকে পক্ষ নিতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে, জাপারোভার বিষয়টিকে এভাবে দেখছেন। ভারত সফরকালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই যুদ্ধের একটি বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে এবং এটাকে শুধু ইউরোপীয় ইস্যু হিসেবে দেখা উচিত নয় এবং এই সংঘাত নিরসনে ভারত আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। পশ্চিমাদের কাছে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের হিসাবটা সরল—বিশ্বব্যবস্থার ওপর মরণ আঘাত। তাদের প্রশ্নটা হলো আন্তর্জাতিক সীমানা কি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বদল করা যায়? রাশিয়া যদি জোর করে ইউক্রেনের ভূখণ্ড নিজেদের করে নেয়, তাহলে বিশ্বের অন্যখানে অন্য কোনো দেশ যদি সেটা করে, তবে কীভাবে সেটা ঠেকানো যাবে? এই প্রশ্নের গভীরতা থেকে যে ভয়ের জন্ম হচ্ছে, তা থেকেই, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একেবারে ঘরের কাছের দেশ সুইডেন, ফিনল্যান্ড পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ নজির দেখা যায়নি। কিন্তু বিশ্বের অন্য প্রান্তে বেশির ভাগ দেশ যুদ্ধের এক বছর পরে এসেও এ যুদ্ধকে অনেক ভিন্নভাবে দেখছে।
দক্ষিণ বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি: ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে জাতিসংঘে সর্বশেষ ভোটাভুটিতে এর একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জাতিসংঘের প্রস্তাবে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানানো হয় ইউক্রেনের মাটি থেকে দ্রুত, শর্তহীন ও পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যেখানে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় সেখানে রাশিয়াপন্থী কিছু দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বড় একটা অংশ ভোটদানে বিরত ছিল। চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও এর মধ্যে রয়েছে। একত্রভাবে বিশ্বের ৪০ শতাংশ ভূখণ্ড শুধু নিরপেক্ষ অবস্থানই নেয়নি, তারা খুব স্বচ্ছন্দে প্রকাশ্যেই সেটা বলছে। ভারতের বিষয়টা বিবেচনা করা হলে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকেই ঐতিহাসিকভাবে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী দেশ তারা। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান সেই ইতিহাসেরই অনুরণন। এখানে একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। চীন যখন ক্রমাগত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সে সময় ভারতের নিরপেক্ষ দেশগুলোর নেতা হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই নিরপেক্ষ অবস্থান ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রভাব ফেলছে। ভারত ও দক্ষিণ বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় দ্বিধাটাই এটি। যেকোনো একদিকে ঝুঁকে পড়লে অপর পক্ষের প্রচারণার অস্ত্র হওয়ার ঝুঁকি আছে। সে ক্ষেত্রে নির্মম যুদ্ধ বিষয়ে চুপ থাকার নীতিতে চলছে তারা। এ যুদ্ধ নিয়ে ভারতের চুপ থাকার আরেকটি কারণ হলো, দেশটি মনে করছে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে আশা করছে, এই যুদ্ধের অবসান সেভাবে হবে না। ভারত ঠান্ডা যুদ্ধের কয়েক দশক দুই পক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এখন ভারত বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে হাঁটছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে অবস্থান বদলের কোনো কারণ নেই ভারতের।
** লেখক বিবিসি ও গার্ডিয়ানের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সাবেক সংবাদকর্মী এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct