বিদায়
হাবিবুর রহমান
অন-উদার পৃথিবী। রূঢ় বাস্তব। সত্তর দশক। সংসারে বড্ড অভাব। বাবা চটকলের বদলি তাঁতি। দু হপ্তা কাজ হয়তো এক হপ্তা বসে।পাঁচ ভাই বোনকে নিয়ে মা হামিদা নাজেহাল। হবি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট -ইংরাজী অনার্স নিয়ে কলেজে পড়ে। মেজভাই ট্রেনে হকারি করে। টেনেটুনে সংসার চলে। মা পাশের বাড়ি মাস্টার গিন্নির হেঁসেলএ রান্না করে। দিনান্তে ভাত পান্তা নে আসে। কোন রকমে দিন কাটে। ফলে সংসারের অভাব আর মেটে না। এমন দিনও গেছে রোজার উপসের পর সন্ধ্যায় পানি ছাড়া কিছু মেলেনি।ভাই বোনদের দিকে তাকালে ছরছররিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে হবির।মা-ই প্রেরণা। বড় বেটাকে বড্ড স্নেহ করে।গভীর রাতে হবি নিরালায় একা একা পড়ে, মা জেগে পাখার বাতাস করে, মাথায় হাত বুলায়, পড়ে যা বাপ্ আমার। কোন দিকে তাকাস না, কোন চিন্তা করিস না। অনেক বড় তোকে হতে হবে বাপ্। বড় তুই, তোর মাথায় অনেক কর্তব্যরে মানিক।পড়ার পাতা ঝাপসা দেখায় হবির। চোখের জল বাঁধ মানেনা।আক্ষেপ করে, মা -মাগো, আর যে পারিনা মা।পরম আদরে মা গায়ে মাথায় হাত বুলায়, কাঁদিস না বাপ্। ধৈর্য ধর। জানবি দুঃখের পর সুখ আসে।হবি ককিয়ে ওঠে, আর কবে সুখ আসবে মা? উচ্ছাসে হবির গলা বুজে আসে। মা বেটা দুজনে জোড়াজড়ি করে নীরবে কাঁদে।হবি বড্ড ভীতু। রাতে ভাই বোনরা বারান্দায় লম্বা হয়ে শোয়। একা ভয়ে রাতে দাবার খুঁটি ধরে ওঠোনে পেচ্ছাপ করে।
মা বোকা দেয়, ওতো বড় ছেলে, দাবায় কেন পেশাব করিস বাপ্? হবি লজ্জা পায়, বড্ড ভয় করে যে মা।মা স্নেহের ধমক দেয়, শোন ছেলের কথা !দুঃখের দিন কাটতে চায় না।জামাইবাবু কোথা থেকে খবর পেলে সেপাইয়ের জন্যে পুলিশে লোক নিচ্ছে আলিপুরে। অনেক ছেলে যাচ্ছে। তখনকার দিনে পুলিশে কিইবা মাইনে !তবু সরকারী চাকরি তো। পরিস্থিতির চাপে পড়ে, কাউকে কিছু না বলে হবিও গেল তাদের সঙ্গে। কী কপাল !ওতো ছেলের মধ্যে হবিই সিলেক্ট হল।মা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, যাসনি বাপ্ তুই আমার কোল খালি করে? তুই জীবনে কোন দিন ঘর ছাড়া হোসনি। ভয়ে রাতে দাবায় পেশাব করিস। তুই করবি পুলিশের চাকরি? এ হবার না বাপ্। হবি চুপ থাকে।দুঃখের সংসার। বাবা আনন্দিত, অন্যেরা খুশি।জয়েনিং লেটার এলো।হবির মনে আছে, পুরোনো কালের টিনের ছোট্ট বাক্স। যায়- জিনিস তার মধ্যে ঢোকায়, আর মা ঝরঝর করে কাঁদে।বাবা বুঝায়, পাড়ার লোক বোঝায়, কিন্তু, মা বুঝ মানে কই !চলে যেতে হবে হবিকে। ভেতরটা খালি খালি লাগে। কত কষ্টের লেখাপড়া ! সে বাঁধন কাটতে হবে। নিজের জন্যে, সংসারের জন্যে।মা হবির গলা জড়ায়, নিশুত রাতে চোখের জল ফেলে,কাল থেকে আর কার গলা শুনব বাপ্, সুর করে কে পড়বেরে আমার ঘরে ? কার গায়ে পাখার হাওয়া করবো রে বাপ্? কথা তো নয়, যেন উগরে ওঠা কান্না। আর সে কান্নার আওয়াজ তীর হয়ে হবির বুকে বিদ্ধ করে।নিজের পরা কাপড়ের খুঁটে মার চোখের জল মোছে, কেঁদো না মাগো, কেঁদো না।আর হবি? তার কান্না কে থামাবে? তবু সেইই মাকে সান্তনা দেয়।পাড়ার শেষে তালপুকুর মোড়। বাক্স পেটরা নিয়ে অনেকের সাথে মাও এল আগাতে। সকাল নটা।মোড়ে লোকজন ভর্তি। মা হটাৎ হবির গলা জড়িয়ে চিলবিল চেঁচায়, পুলিশে যেয়ে তোর কাজ নেই বাপ্। তু ঘরেই থাক মানিক। তোকে ছেড়ে আমি বাঁচবো নারে, বাঁচবো না।কান্নাকাটি দেখে অনেকে ভাবে কারো মেয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। লোক জড়ো হয়।
হবিও ডাক ছেড়ে কাঁদছে।বিস্ময়ে অবাক সবাই। মোড়ল মন্টু জ্যেঠু এগিয়ে আসে। মাকে বোকা দেয়, কী আক্কেল বৌমা। আজ তোমার খুশির দিন। ছেলে যাচ্ছে চাকরি জয়েন করতে। তুমি তাকে হাসিমুখে বিদায় দাও মা।অন্যেরাও মাকে বুঝ দেয়। কিন্তু মায়ের প্রাণ তো। বুঝ মানে কই।গরমকাল তালপুকুরের জল ঢেউয়ে চলকায়। অভাগী মায়ের চোখের জল তেমনি চলকায়।বুকের গুরগুরুনি থামে কই !কেবলি থাক্কা খায়।বাবা ছেলেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলো, ছাড়ো গিন্নি ট্রেন যে চলে যায়।কাঁদতে কাঁদতে হবি বাবার সঙ্গ নিলো। দুপা যায়, আর পেছনে তাকায়। হতভাগী মা তখনো উথাল পাতালী যাচ্ছে।দৃষ্টিসীমার বাইরে হবির মনটা হুহু করে উঠল। বেচারা কাঁচা চাল চিবোয়। গত রাতে মা তার ঐ টুকু টিনের বাক্সে এক বোয়াম কাঁচা চাল যত্ন করে ঢুকিয়ে দিল।ছেলে জোর আপত্তি করে। মা মানল না, বিদেশ বিভুঁই, কোথায় পাবিরে বাপ্, নে সঙ্গে।এই তার মা -গর্ভধারিণীমা। তাকে ছাড়া কেমন করে থাকবে সে দূর দেশে !অথচ, ট্রাজেডি। বছর না ঘুরতে সেই হতভাগী মা চলে গেল নাগালের বাইরে।পুলিশের চাকরি।প্রায়ই রাত পাহারা পড়ে। অন্ধকার আকাশে হতভাগা হবি আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিযে থাকে।অজস্র তারাদের মেলা। আকুপাঁকু করে খোঁজে তার মা কই। না, রাত যে বয়ে যায়। কিন্তু, কোথায় তার মা? কোত্থাও তো নেই।কেবল মনের মধ্যে ভেসে উঠছে বিদায়ের দিনে সেই তালপুকুর মোড়। মা বেটা দুজনে জোড়া জড়ি করে কাঁদছে, কাঁদছে তো কাঁদছে। মা তো এখন বেহেশতে। আর হবি? হবির সে কান্না আজও থামেনি। কাঁদছে,কাদঁছে, কেবলি কাঁদছে...।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct