বাংলার নবজাগরণ বলতে বোঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাবকে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সময়ে। যদিও এর পরেও বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অনন্য সমাহার যা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে। তা িনয়ে সন্দর্ভটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার...
৬. তিতুমির (১৭৮২-১৮৩১)
উনিশ শতকের প্রথমার্দ্ধের বাংলার গণবিদ্রোহের ইতিহাসে তিতুমির ( মির নিশার আলি) একটি স্মরণীয় নাম। তখন জমিদারেরা ছিলেন শোষক ও অত্যাচারী। তাঁদের করের বোঝায় চাষিদের নাভিশ্বাস উঠেছিল। তিতুমির সেই সব গরিব চাষি ও তাঁতি সম্প্রদায়ের মানুষের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। বেশ কয়েকজন জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি জয়লাভ করেন। নারকেলবেড়িয়ায় নির্মাণ করেন এক বাঁশের কেল্লা। সেখানে থাকতেন তাঁর অনুগামী ৫০০ সৈনিক। নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করেন তিতুমির। ইংরেজ সেনারা অশ্বারোহী সৈন্য ও কামান নিয়ে আক্রমণ করেন বাঁশের কেল্লা। যুদ্ধে নিহত হন তিতুমির , তাঁর সেনাপতি মাসুমের ফাঁসি হয়।
দ্রষ্টব্য: তিতুমিরের লড়াই / দেবশ্রী দাস। তিতুমির / সৈয়দ নজমুল আবদাল। তিতুমির / সাইয়েদ নিশার আলি। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক / সুপ্রকাশ রায়
৭. (রাজা) রাধাকান্ত দেব ( ৭৮৩- ১৮৬৭)
বাংলার নবজাগরণে রাধাকান্ত দেব এক বিতর্কিত চরিত্র। একদিকে তিনি রক্ষণশীল সমাজের নেতা ; সতীদাহ প্রথা বিলোপের জন্য সরকারি আইনের প্রতিবাদে গঠন করেছেন ধর্মসভা (১৮৩০), প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন মিশনরিদের ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টার , সংস্কৃত শিক্ষাবিস্তারের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন , হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিওকে বিতাড়নের চেষ্টায় সামিল হচ্ছেন ; আবার অন্যদিকে শিক্ষাবিস্তার প্রভৃতি প্রগতিমূলক কাজে অংশগ্রহণ করছেন। হিন্দু কলেজর সঙ্গে প্রায় ৩২ বছর যুক্ত ছিলেন তিনি , কলেজের নীতিনিয়ম নির্ধারণে ভূমিকা ছিল তাঁর। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি কোন বিরাগ ছিল না ; তিনি চাইতেন এই শিক্ষা যেন দেশ ও জাতির ঐতিহ্যকে অবজ্ঞা করতে না শেখায়। বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁর উৎসাহ ছিল। চিকিৎসাবিদ্যা ও শল্যবিদ্যাশিক্ষার জন্য যে সব দেশীয় ছাত্র ইংল্যাণ্ড গিয়েছিলেন , রাধাকান্ত তাঁদের আর্থিক সাহায্য দেন। স্কুল সোসাইটির পরিচালন সমিতির তিনি ছিলেন ভারতীয় সম্পাদক। এগ্রিকালচারাল ও হর্টিকালচারাল সোসাইটির সহ-সভাপতি ছিলেন রাধাকান্ত। ২৪ পরগণার কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছিলেন। কৃষি ও শিল্পশিক্ষার প্রতিষ্ঠান তৈরির ব্যাপারেও উৎসাহ দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর উৎসাহ ছিল স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারেও। বেথুনসাহেব এ ব্যাপারে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। দরিদ্র পরিবারের বালিকাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি মিস কুককে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মিশনরি স্কুলের বিকল্প হিসেবে যে হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিটুশন প্রতিষ্ঠিত হয় রাধাকান্ত যুক্ত ছিলেন তার সঙ্গে। ১৮৫৩ সালে মেট্রোপলিটন কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ যাঁরা গ্রহণ করেন , তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। চল্লিশ বছরের পরিশ্রমে যে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ তিনি তৈরি করেন, তার মুক্তকণ্ঠ প্রশংসা করেন ভারতীয় ও ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গ। ভূম্যধিকারী সভার সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ইংরেজের জাতিবৈষম্য , বিচার বিভাগের বৈষম্য , ব্ল্যাক অ্যাক্টের প্রতিবাদ করেছিলেন রাধাকান্ত। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করার জন্য জেমস লঙ অভিযুক্ত হলে রাধাকান্ত তাঁর পাশে দাঁড়ান। বিচারের সময় ওয়েলস নামক বিচারক ভারতীয়দের চরিত্র সম্পর্কে কটাক্ষ করায় রাধাকান্ত তার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতিবাদপত্র পাঠান চার্লস উডের কাছে।
দ্রষ্টব্য: রাধাকান্ত দেব ( সাহিত্য সাধক চরিতমালা ) / যোগেশচন্দ্র বাগল। Rajah Radhakanta Deb , K.C.S.I---A Brief Account of his Life and Character / Rev, Krishnamohan Bandopadhyaya . A Rapid Sketch of the Life of Raja Radhakanta Deva Bahadur , with some notices of his ancestors and testimonials of his character and learning / The Editors of the Raja’s Sabdakalpadruma . A Conservative Hindu of Colonial India : Raja Rdhakanta Dev and His Milieu / Syamalendu Sengupta .
৮.রামকমল সেন ( ১৭৮৩-১৮৪৪)
স্বশিক্ষিত মানুষ ছিলেন রামকোমল সেন। ইংরেজি ভাষায় লাভ করেছিলেন অসাধারণ দক্ষতা। প্রধমে তিনি কেরানির চাকরিতে নিযুক্ত হন , তারপর এশিয়াটিক সোসাইটির দেশীয় সেক্রেটারির পদ লাভ করেন , শেষে ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ান নিষুক্ত হন। হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন , সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক ছিলেন , স্কুল বুক সোসাইটির সদস্য হন। পরে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনেরও সদস্য হন। ‘গৌড়ীয় সমাজে’র সম্পাদক হিসেবে তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার পথ প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন। আদালতের কাজকর্ম যাতে বাংলা ভাষায় চালু করা যায় তার চেষ্টা করেছেন। ফেলিক্স কেরির সাহায্যে তিনি ৭০০ পাতার একটি গুরুত্পূর্ণ অভিধান ( ইংলিশ বেঙ্গলি ডিকশনারি ) সংকলন করেছিলেন। নিষ্কর জমির পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে সরকারি নীতির তীব্র সমালোচনা করেন রামকমল। ভারতীয়দের সমস্যা ব্রিটিশ জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার জন্য লণ্ডনে একজন ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি।
দ্রষ্টব্য: রামকমল সেন / প্যারীচাঁদ মিত্র। রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ / শিবনাথ শাস্ত্রী। Dewan Ramcomul Sen and His Times / Pradyot Kumar Ray . Ramkamal Sen / Ronald Conn .
৯. রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ (১৭৮৬-১৮৪৫)
স্মৃতিশাস্ত্র , উপনিষদ , বেদান্তে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন রামচন্দ্র। রামমোহন রায়ের মতো একেশ্বরবাদের প্রচারে নিযুক্ত হন। প্রতিমা পূজা সম্পর্কে বিতর্কেও অংশগ্রহণ করেন। ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হলে তিনি তার ফার্স্ট মিনিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনিই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন। তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি ; কারও কারও মতে সভার নামকরণ তিনিই করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা সমর্থন করে তিনি রামমোহনের বিরাগভাজন হয়েছিলেন ; কিন্তু তিনি বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন। ‘নীতিদর্শন’ বক্তৃতায় তিনি হিন্দুদের বিবাহরীতির সংস্কারের কথা বলেন এবং বহুবিবাহের বিরুদ্ধতা করেন। বাংলা ভাষা প্রসারের ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ স্মরণীয়। ১৮৪০ সালের ১৮ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ পাঠশালার উদ্বোধনের দিন তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন যে বাংলা ভাষাচর্চার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। ১৮১৮ সালে তিনি যে বাংলা অভিধান সংকলন করেন তার ভূয়সী প্রশংসা করেন স্কুল বুক সোসাইটি।
দ্রষ্টব্য: রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ( সাহিত্য সাধক চরিতমালা ) / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আত্মচরিত / দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। The Father of Modern India (edt) / S.C.Chakraborty .
১০. ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮)
সরকার ও মুৎসুদ্দি হিসেবে নানা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও সাংবাদিকতা ছিল তাঁর সবচেয়ে পছন্দের কাজ। সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সম্বাদকৌমুদী’তে তিনি কাজ করেছেন , কিন্তু রামমোহন ও হরিহর দত্তের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি সে পত্রিকার কাজ ছেড়ে দেন। এরপর কলুটোলায় নিজস্ব মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করে ১৮২২ সালের ৫ মার্চ থেকে সাপ্তাহিক ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি তখনকার রক্ষণশীল সমাজের মুখপত্র হয়ে ওঠে।ব্রাহ্মসমাজের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে যে ‘ধর্মসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় , ভবানীচরণ ছিলেন তার সম্পাদক। তিনি সতীপ্রথার সমর্থক হলেও বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। স্ট্যাম্প ডিউটির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি চন্দ্রকুমার ঠাকুরের সহযোগী ছিলেন। গৌড়ীয় সমাজের সভ্য হিসেবে ভবানীচরণ বাংলাভাষার উন্নতি ও প্রসারের চেষ্টা করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধতা না করলেও ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদের উচ্ছৃঙ্খলতা সহ্য করতে পারেন নি। তখনকার কলকাতার সমাজের বিকৃতির তিনি এক বিশিষ্ট রূপকার। তিনি লিখেছিলেন ‘কলিকাতা কমলালয়’ , ‘নববাবুবিলাস’ , ‘নববিবিবিলাস’ , ‘দ্যুতিবিলাস’।
দ্রষ্টব্য: ধর্মসভার অতীত সম্পাদক বাবু ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনচরিত / রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (সাহিত্য সাধক চরিতমালা ) / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত / লোকনাথ ঘোষ। বাবু গৌরবের কলকাতা / বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct