আপনজন ডেস্ক: পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুজালেম শহরে অবস্থিত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল-আকসা। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর বুকে সব জাতি-বর্ণের মুসলমানদের প্রাণস্পন্দন। অন্যদের মাধ্যমে দখল করা যেকোনো মুসলিম ভূখণ্ড উদ্ধার করা সমগ্র মুসলমানের দায়িত্ব। তবে ইসলামের প্রথম কিবলার দেশ ফিলিস্তিনের বিষয়টি অন্য সবগুলোর চেয়েও ভিন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ। আর জেরুজালেমের এই স্থানটিকেই নিজেদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে ইহুদি এবং খ্রিস্টানরাও। সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববীর পরই, মুসলমানদের কাছে পবিত্র স্থান জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ। খ্রিস্টপূর্ব ১০০৪ সালে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন হজরত সোলায়মান (আ.)। এরপর বিভিন্ন সময়ই এর সংস্কার করা হয়। দুটি বড় ও ১০টি ছোট গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণশৈলীর এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি। বিভিন্ন সময়ে মসজিদটি সংস্কারে ব্যবহার করা হয় মার্বেল, সোনাসহ নানা ধরনের মূল্যবান ধাতু ও পাথর। ঐতিহাসিকভাবেই আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের পবিত্র স্থান। তার পরও এটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে ইউনেস্কো। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি অবৈধভাবে দখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইহুদিরাষ্ট্র ইসরায়েল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধে, আল-আকসা মসজিদ দখল করে নেয় দেশটি। এরপর থেকেই এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দখলদার ইসরায়েল। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর আল-আকসা পুরোপুরি বন্ধ থাকে। এমনকি ১৯৬৯ সালে পবিত্র মসজিটিতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এরপর নানা বিধিনিষেধ আর শর্তসাপেক্ষে সেখানে ইবাদতের সুযোগ পেতেন সাধারণ মুসল্লিরা। পরে আবারও বিভিন্ন অজুহাতে ইসরায়েলি বাহিনী আল-আকসা মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৩ সালে জেরুজালেমে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের আল-আকসায় প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরায়েল। সংকট আরো ঘনীভূত হয়। বিভিন্ন সময় ইহুদিরা মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়।
ইহুদিদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত। তাদের দাবি, এর নিচেই রয়েছে তাদের দুটি প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও আল-আকসা মসজিদের স্থাপনাকে তাদের পবিত্র স্থান হিসেবে দাবি করে আসছে। মসজিদ আল-আকসাসহ অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত যার চত্বরে আজও অসংখ্য নবী-রাসুলের সমাধি বিদ্যমান। মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকেরই অজানা। বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম জাতির বাবা হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর। তার নাতি বনি ইসরায়েলের প্রথম নবী হজরত ইয়াকুব (আ.) ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সুলায়মান (আ.) এ পবিত্র মসজিদ পুনর্নির্মাণ করেন। ইসলামের আগমনের পর প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর ইন্তেকালের কয়েক বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রথম দিকে এ মসজিদটি কিছু দিনের জন্য মুসলমানদের কেবলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৫ জুলাই ১০৯৯ সাল। ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক বেদনাদায়ক দিন। সে দিন অযোগ্য মুসলিম শাসকদের ছত্রছায়ায় খ্রিস্টান ক্রুসেডার বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপরই ঘটতে থাকে হৃদয়বিদারক অসংখ্য ঘটনা। যা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড়ই বেদনাদায়ক। খ্রিস্টানরা ১০৯৯ সালের ৭ জুন প্রথমে জেরুজালেমে অবস্থিত ‘বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদ আল-আকসা’ অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে। অতঃপর এ পবিত্র মসজিদে তারা তাদের উপাসনালয় গির্জায় পরিণত করে। বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার ২৩ মার্চ ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দ। ফাতেমীয় খেলাফতের রাজত্বকালে খলিফার নির্দেশে সেনাপতি হজরত সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গভর্নর ও সেনাপ্রধান হয়ে মিসরে আগমন করেন। ২০ সেপ্টেম্বর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সমরাভিযানের মাধ্যমে তিনি মসজিদ আল-আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। ২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ও গভর্নর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীবেশে বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দিব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ- এ তিনটির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরিফ’ এর চার দেয়ালের মধ্যেই অবস্থিত। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তার ছেলে খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসূরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।
বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুজালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডানি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে। ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে মুসলমানদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হজরত ইবরাহিম এবং মুসা (আ.) সহ অসংখ্য নবী ও রাসুল। এখানেই মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সব নবী-রাসুল এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়েছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিজেই। এখান থেকেই হজরত মোহাম্মদ (সা.) বোরাকে করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত আদম (আ.), হজরত সুলাইমান (আ.) এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক হজরত উমর (রা.), দ্য গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবিসহ অসংখ্য বীরের নাম। এই মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলে একজনের আমলনামায় ৫০০ রাকাত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হয়। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা। প্রথম নির্মাণ খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে, মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মিরাজের রাতে হজরত রাসুল (সা.) কে বোরাকে চড়ে মক্কা থেকে এখানে এসেছিলেন। অনেক বছর ধরে মসজিদুল আকসা বলতে পুরো এলাকাকে বোঝানো হতো এবং মসজিদকে আল-জামি আল-আকসা বলা হতো। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৯৫৭ সালে বাদশাহ সলোমন বা সুলাইমান (আ.) নির্মাণ করেন এই ‘প্রথম মসজিদ’ বা বায়তুল মুকাদ্দাস নামে চিরচেনা মসজিদ আল-আকসা। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় মসজিদ কাঠামোটি। পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবেলের পৃষ্ঠপোষকতায় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৬ সালে নির্মিত হয় দ্বিতীয়বার এই মসজিদ সেই আগের জায়গায়ই। মুসলিমদের প্রথম কিবলা এই মসজিদ আল-আকসা ইহুদিদেরও প্রার্থনার কেন্দ্রস্থল। এই মসজিদ আল-আকসার দিকে ফিরেই মুসলিমরা আগে নামাজ আদায় করতেন মদিনায় হিজরতের ১৭তম মাস পর্যন্ত। মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মসজিদ আল-আকসার প্রথম নির্মাণের আগেই দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন সুলাইমান (আ.)। অন্যদিকে ইহুদিদের কিতাবগুলোতে এই আল-আকসা নিয়ে প্রচুর বিবরণ রয়েছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরাও ধ্বংস করে দিয়েছিল এই আল-আকসা। ইতিহাসের ঘাত-প্রতিঘাতে বহুবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে এই অন্যতম পবিত্র স্থানটি। বর্তমানেও ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের হাজারো সাক্ষী এই মসজিদ আল-আকসা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct