দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশ ও এর মাধ্যমে তাঁকে লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করা ভারতের রাজনীতিকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কার অভিঘাত পার্লামেন্টের উভয় কক্ষকেই শুধু নাড়িয়ে দেয়নি, তার বাইরে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পাশাপাশি এটি দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর সংশয় তৈরি করেছে। তবে বিরোধী দলগুলো এক হলে তা বিজেপির জন্য খারাপ খবর বয়ে আনবে। এ নিয়ে লিখেছেন শশী থারুর।
বিরোধী দল জতীয় কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশ ও এর মাধ্যমে তাঁকে লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করা ভারতের রাজনীতিকে একটি বড় ধাক্কা দিয়েছে। সেই ধাক্কার অভিঘাত পার্লামেন্টের উভয় কক্ষকেই শুধু নাড়িয়ে দেয়নি, তার বাইরে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পাশাপাশি এটি দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে গভীর সংশয় তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে কর্ণাটকে দেওয়া একটি ভাষণের জেরে রাহুলকে নিশানা করা হয়েছিল। ভারতের অর্থনৈতিক দুরবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার একপর্যায়ে রাহুল বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, ভারতের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ভগ্নদশার জন্য ছয়জন দায়ী। তাঁরা হলেন নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মাল্য, ললিত মোদি, অনিল আম্বানি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাহুল গান্ধী ভাষণে বলেছিলেন, ‘এক ছোটা সা সওয়াল। ইন সব চোরো কি নাম “মোদি, মোদি, মোদি” ক্যায়সে হে? অর আভি থোড়া ঢুন্ডোভি তো বহুৎ সারি মোদি দেখলেঙ্গে (একটা ছোট্ট প্রশ্ন, সব চোরের নাম ‘মোদি, মোদি, মোদি’ হয় কেমন করে? আরেকটু খুঁজলে তো আরও অনেক মোদি বের হয়ে আসবে)।’ নিশ্চিতভাবেই রাহুল গান্ধী ভারতের অর্থনীতিকে লুট করার অভিযোগে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সমালোচনা করেছিলেন। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজনের ডাকনাম একই। আপনি হয়তো বলতে পারেন, রাহুলের এভাবে নাম ধরে বলাটা মোটেই দরকার ছিল না।কিন্তু ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনেক নেতাসহ রাজনীতিকেরা নির্বাচনী ভাষণে প্রতিপক্ষ ও সংখ্যালঘুদের নাম ধরে এর চেয়ে অনেক খারাপ ভাষায় সমালোচনা করেছেন, কিন্তু কাউকে এভাবে ফৌজদারি মামলায় পড়তে হয়নি। বিজেপির আইনপ্রণেতা পূর্ণেশ মোদি, রাহুলের বিরুদ্ধে মামলা করে অভিযোগ করেন, রাহুল গোটা ‘মোদি সম্প্রদায়কে’ চোর বলেছেন। গুজরাটের সুরাটের একটি আদালত সেই অভিযোগকে আমলে নিয়ে রাহুলকে দোষী সাব্যস্তও করেছেন। তবে পুরো গল্পটা বেশ ঘোলাটে। ২০১৯ সালে যে বিচারকের আদালতে প্রথম এই মামলার শুনানি হয়েছিল, সেই বিচারক বলেছিলেন, মামলাটিতে অভিযোগের ভিত্তি খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছিল, তিনি মামলাটি খারিজ করে দেবেন। এটি বুঝে পূর্ণেশ মোদি মামলাটি স্থগিত করার জন্য হাইকোর্টে ছুটে যান। তখন থেকে মামলাটি স্থগিত ছিল। সেই ঘটনার দুই বছর পর রাহুল গান্ধী পার্লামেন্টে একটি বক্তৃতা দেন (যার একটি বড় অংশ পার্লামেন্টের নথি থেকে বাদ দেওয়া হয়)। বক্তৃতায় তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে নিজ বলয়ের ব্যবসায়ীদের হাতে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার অভিযোগ করেন এবং তার পরপরই পূর্ণেশ মোদি তাঁর মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করার জন্য হাইকোর্টে ফিরে যান।
মজার বিষয়, সুরাটে মোদি আসার ঠিক আগেই সেখানকার আগেকার বিচারককে সরিয়ে নতুন বিচারক বসানো হলো এবং সেই নতুন বিচারক শুধু সেই মামলাকে পুনরুজ্জীবিতই করলেন না, মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে রাহুলকে দোষী সাব্যস্ত করে রায়ও দিয়ে দিলেন। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, কোনো পার্লামেন্ট সদস্যের যোগ্যতা বাতিল এবং পরবর্তী অতিরিক্ত ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করতে যে দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশের প্রয়োজন হয়, সেই প্রয়োজনও এই রায়ে পূরণ করা হয়েছে। বিজেপি সরকার রায় কার্যকর করার জন্য মুখিয়ে ছিল। রায়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লোকসভা সচিবালয় থেকে ঘোষণা করা হয়, রাহুল গান্ধী আর এমপি নন এবং এর পরের কার্যদিবসেই তাঁকে তাঁর সরকারি বাংলো খালি করতে চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়। কংগ্রেসের রাজনীতিকেরা বলেছেন, এই রায় যথাযথ বিচারিক বিধি মেনে হয়নি; এই রায় হয়েছে সরকারের শীর্ষ মহলের আগে থেকে ঠিক করে রাখা সিদ্ধান্ত মেনে। তাঁদের ভাষ্য, এর মাধ্যমে আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত রাহুলের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। রাহুল গান্ধী এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। যদি আদালত তাঁর সাজার রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেন, তাহলে পার্লামেন্টের সদস্য থাকার যোগ্যতাও তিনি ফিরে পাবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি রাজপথ ও পার্লামেন্টে সরব—এমন একজন নেতা হিসেবে ফিরবেন, যাঁকে সরকার স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।সে ক্ষেত্রে জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থনে উদ্দীপ্ত হওয়া কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বিজেপির জন্য সপ্তাহ কয়েক আগের চেয়ে আরও অনেকে বড় কাঁটা হিসেবে দেখা দিতে পারেন। এই রায় ইতিমধ্যেই ভারতের সরকারবিরোধীদের জাগিয়ে তুলেছে। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, পশ্চিমবঙ্গের অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, তেলেঙ্গানায় ভারত রাষ্ট্র সমিতি ও কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়াসহ (মার্ক্সবাদী) রাজ্যভিত্তিক যে দলগুলো ঐতিহ্যগতভাবে কংগ্রেসের বিরোধিতা করে থাকে, তারাও রাহুল গান্ধীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। মনে হচ্ছে, তারা বুঝতে পারছে, যেকোনো সময় তারাও সরকারের কূটচালের শিকার হতে পারে। আর বিরোধী দলগুলো এক হলে তা বিজেপির জন্য খারাপ খবর বয়ে আনবে। কারণ, পার্লামেন্টে বিজেপির ৬০ শতাংশ আসন থাকলেও ২০১৯ সালের নির্বাচনে তাঁরা মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। যদি পার্লামেন্টে থাকা বাকি ৩৫টি দল এক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেদের মধ্যে ভোট ভাগ না করে যৌথভাবে প্রার্থী দেয়, তাহলে ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া খুবই কঠিন হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct