দোয়া কবুল
হাবিবুর রহমান
হারমোনি মার আদরের দুলাল- হবি। বড় সংসার। পাঁচ ভাইবোন মা-বাপ। বাপ কলকাতায় এক চটকালে বদলি তাঁতী। মাসে দুহপ্তা কাজ হলো তো এক হপ্তা বন্ধ। ফলে টেনে টুনে চলত সংসার।মা পাশের বাড়ির মাষ্টার গিন্নির হেসেলে কাজ করত। এঁটো কুটো যা পেত বাচ্চাদের মুখে তুলে দিত। গরীব হলে যা হয়। মানুষজন সহজে কাছে ঘেঁষে না। পাছে কিছু চেয়ে বসে। সত্তরের দশকে এ দৃশ্য হামেশা দেখা যেত। মাটির দেওয়াল খড়ের চাল।বর্ষায় দাবাঘরে পানি চুইতো। প্রায় সবারই ঘরে অভাব কে কাকে সাহায্য করবে? আর হারমনি বিবিকে? মোটেই নয়। পাড়ায় প্রবাদ ছিল, হারমনি নিলে, দেয় না। সত্যি বলতে কি বাচ্চাদের মুখে দিয়ে দেনা শোধার সামর্থ ছিল না। এমনও দিন গেছে রমজানের উপোস এর পর ইফতারে পানি ছাড়া কিছু জোটেনি। সেই অবস্থায় পরদিন রোজা করেছে হবি। কঠিন কৃচ্ছ সাধনার পর আসে খুশির ঈদ।ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই আনন্দ করে যে যার আওকত অনুযায়ী। খুশির খবর এ হপ্তায় বাপের কাজ হচ্ছে। রবিবার ঈদ। শনিবার বাপের হপ্তা হয়। সেদিন আবার উস্থির হাট। মা দুপুর থেকে থলে টলে দিয়ে বললে, যা বাবা আগে আগে, মানুষটা আসছে কষ্ট করে অতো দূর থেকে? বাজার টাজার বয়ে আনবি বাপ।
হবি মনের আনন্দে দৌড়ায়। বাপকে ভজিয়ে পয়সা হাতাবে। কাল ঈদে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করবে। কী মজা। হবি সোজা বাস স্ট্যান্ডে বসে থাকে। এক ঘন্টা অন্তর বাস। বাস এলে সে ভিড়ের মধ্যে পড়িমরি করে ঢুকে পড়ে বাপকে নিতে। শেষে হতাশ হয়ে বসে পড়ে।এ বাসে বাপ তো এলো না। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা।বাপের দেখা নাইরে। সান্ধ্য তো গেল, হাট ফাঁকা। লোকজন বাড়ি মুখো। শেষ বাসে তাদের পাড়ার আলি চাচা নাবল। তার বাপের সঙ্গে একই চটকালে কাজ করে। হবি তাকে জাপটে ধরে, চাচাজি, বাপ, আমার বাপ কোথায়? আলি চাচা ভিড় ঠেলে ফাঁকায় এসে বললো, তোর বাপ কাবলিওয়ালার কাচতে সুদে টাকা নেছেলো। অনেক দিন হলো কর্য চুকাতে পারেনি। আজ সে তক্কে তক্কে ছিল। গেটের বাইরেতে এলে তোর বাপের হপ্তার টাকা কেড়ে নেছে। সেই দুক্কে তোর বাপ বাড়ি এলোনা। রাত হচ্ছে,চল বাড়ি যাই। ভগ্নমনে, খালি থলে নিয়ে বেচারা হবি ঘরে এলো। মার তো মাথায় হাত। ছোট বোনটা দৌড়ে এলো,দাদা,দাদা। আব্বা কই? আমার লাল ফ্রগ এনেছিস তো? থলে খালি, ফ্রগ কই, আর বাপও বা কই? অতোটুকু মেয়ে কান্না জুড়ে দিলে।হতভাগী মা নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।দিল এক চর। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে বেচারি বাইরে বেরিয়ে গেল। পরদিন খুশির ঈদ। ঘরে ঘরে ক্ষির পায়েস। কিন্তু হবিদের সে সামর্থ কোথায়!ঘরে ভুট্টার আটা ছিল। মা নুন দিয়ে তাই আউটালো। ছোট বোন। নাবুজ। চিলবিল চেঁচায়, না,খাবুনি এ পায়েস।এটা তো ভুট্টা? আমার পায়েস চাই।
শেষে মা মাষ্টার গিন্নির কাছ থেকে একটু পায়েস এনে তাকে থামালো। খুশির ঈদ চলে গেল।রাতে হবির চোখে পানি। ছেলে অন্ত প্রাণ। ঠিক বুঝতে পেরেছে। পাঁচ শিকের খোলপা কেনারও তাকত ছিল না।বস্তায় শুয়ে।অভাগী মা হবির চোখের পানি মুছে দেয় নিজের ছেড়া ময়লা কাপড়ে। তারও চোখে পানি। তারি মাঝে বললে, সোনারে,কাদিস না বাপ আমার।কাল চরকির মতন ঘুরছে। আজ কষ্ট এসেছে, সহ্য কর,দেখবি সুদিন আল্লাহপাক ঠিকই দেবে। তার ওপর ভরসা রাখ বাপ। মাটির দেওয়ালে সাটা একটা বিবর্ণ ছবি।ছবিটা পবিত্র মক্কা শরীফের। সেইটা দেখিয়ে মা বলেছিল, ওইযে ছবি দেখছো, ওটা পবিত্র কাবা শরীফ। আল্লার ঘর।আয় বাপ, মায়ে পোয়ে দোয়ামাঙি,আল্লাহ পাকগো আমাদের অভাব মোচন করে দাও। হবির চোখ দিয়ে ছর ছরিয়ে পানি ঝরতে থাকে। মা স্বগোত্তি করলে, হাজি সাহেবরা এই খোদার ঘর ঘোরে,সামনাসামনি দেখে। গরীপের গরীপ, হদ্য গরীপ। যেতে তো পারবিনি বাপ। ছবিতে দোয়া মাঙ্গ। মনের আঁশ মিটিয়ে নে। আজ মনে হয় সব যেন স্মৃতি। মা, হবির হারমনি মা তো আজ বেহেশতে। আর হবি? হবির দোয়া, হবির মায়ের দোয়া আল্লাহ্ মালিক কবুল করেছেন। হবি নিজ চক্ষে খানায়ে কাবা দর্শন করেছে, তওয়াফ করেছে। চক্ষের পানি ফেলতে হয় নি। আপনা থেকেই ঝর ঝরিয়ে পড়েছে। সেদিনের ঈদের স্মৃতি ভেসে উঠেছে। হবি প্রাণ ভরে মায়ের জন্যে দোয়া মেঙ্গেছে। পরওয়ারদিগারের কাছে শুকরিয়া আদা করেছে, আল্লাহপাকগো, তুমি,তুমি মেহেরবান।তুমি সব পার,সব করতে পার। দুনিয়ায় তোমার অদেয়ার কিছুই নেই।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct