আপনজন
আহমদ রাজু
পুরোহিত আর নিজেকে স্থির রাখতে পারে না। বলল, “মা জননী, দুই জন কণের সাজে! ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবে? আর হ্যা, যার বিয়ে তাকে একটু লাজুক থাকতে হয়। এটাই পরম্পরা। নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলতে হয় না।”“দু’জন বিয়ের সাজে? এখনই জানতে পারবেন। আর যার বিয়ে সে কথা বলছে, আপনাকে কে বললো? দুনিয়া কী এতই আধুনিক হয়ে গেছে?” বলল সেজুঁতি।কথাটা কানে যেতেই উপস্থিত অতিথিরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে থাকে। কী হচ্ছে এসব!পুরহিত হন্তদন্ত হয়ে বলল, “বুঝলাম না মা?”“আপনার বুঝে কাজ নেই। আপনি শুরু করুন। বর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আপন বন্দোপাধ্যায় আর কণে মহিমা কর্মকার।”হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কথাটা সারা ঘরময় ঘুরতে থাকে। কী বলছে মেয়েটা? স্যারের সাথে তার মায়ের বিয়ে! ‘মহিমা কর্মকার’ নামটা কানে যেতেই চমকে ওঠে আপন স্যার। মুহূর্তে তার হৃদয়পুরের পুরোনো ক্ষতস্থান আবারো জাগ্রত হয়। সে সামনের দিকে তাকায়। মহিমা ঘোমটা দিয়ে থাকায় এতক্ষণ সামনের মানুষটিকে দেখতে না পেলেও সেজুঁতির কথায় সে ঘোমটা সরিয়ে আপন স্যারের চোখে চোখ রাখে। চিনতে মোটেও অসুবিধা হয় না। আপন তুমি! চোখ ছল ছল করে ওঠে মহিমার। তার ঠোঁট দু’টি নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠে। “কত খুঁজেছি তোমাকে। এত কাছে থেকেও বহু দূরে ছিলে।” বলল আপন স্যার। তাঁর চোখের কোণে দেখা যায় জলের রেখা। চশমাটা খুলে চোখ মোছার বৃথা চেষ্টা করে। তারা দু’জনে মুহূর্তে হারিয়ে যায় উনিশ বছর আগে ফেলে আসা ৭১ এর উত্তাল দিনগুলোতে।মহিমার সাথে আপনের ভালবাসাটা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকা অবস্থায় ঘুরতে থাকে জীবনের মোড়। আপন বরাবরই ইংরেজিতে কাঁচা ছিল। যে কারণে টেনেটুনে এসএসসি পাশ করলেও এইচ এস সি পরীক্ষায় সে দু’বার ফেল করে। আর এই কারণে মহিমার বাবা ভূবন কর্মকার মেয়েকে আপনের থেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পড়াশুনায় কাঁচা, দরিদ্র ঘরের একটি ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক সে মেনে নিতে পারে না। সমূহ বিপদ আঁচ করতে পেরে মেয়েকে খুলনার বিএল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়। তার খালাবাড়ি কলেজের পাশে ফুলতলা থানায়। ওখান থেকে কলেজে যাওয়া আসা তার জন্যে সহজ।
অস্থিতিশীলতার কারণে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে মহিমা আর আপন বাড়িতে ফিরে আসে। ইতিমধ্যে চারিদিকে যুদ্ধের দামামা বেঁজে উঠেছে। ঢাকার রাজপথ উত্তাল। জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তেজনা। গ্রামে যার প্রভাব পড়তে বেশি সময় লাগে না। আবাল বৃদ্ধ বণিতা মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে- কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে চলেও গিয়েছে। এলাকার হিন্দু পাড়ার অনেকে জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। শুধু হিন্দু বললে ভুল হবে, মুসলমানরাও বাদ যায় না তার থেকে। হাজার হাজার মানুষ পিঁপড়ার ঝাঁকের মতো পাড়ি দিচ্ছে প্রতিবেশি দেশ ভারতে।খান সেনারা যে গ্রামে ঢুকছে সে গ্রাম তছনছ করে তবেই শান্ত হচ্ছে। নারী-শিশুরা বাদ যায়না তাদের হাত থেকে। আপনের বাবা বেঁচে নেই। গত বছর ফাল্গুনের আঠারো তারিখে টাইফয়েড জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছিল। বড় দাদা ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। সে মাকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগ্রহের কথা জানালে তিনি তখনই জয় তিলক কপালে এঁকে দিয়ে বলেছিল, “যা বাবা, দেশ মাতাকে রক্ষা কর।”“তোমাকে রেখে যেতে মন তো সাঁই দিচ্ছে না মা।” “আমার চিন্তা তোকে করতে হবে না। ফিরে এসে যদি দেখিস আমি নেই তাহলে দুঃখ করবি না। ভাববি বিজয়ের পতাকায় আমি আছি।”“মা তুমি চিন্তা করো না। বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে তবেই তোমার কাছে ফিরে আসবো। এ আমার প্রতিজ্ঞা।” বলেছিল আপন।মহিমার কাছে কথাটা জানালে সে বলে, “আমার কপালে সিঁদুর দিয়ে তারপর যাও। যাতে আমি তোমার অপেক্ষায় থাকতে পারি।” আপন বিভিন্ন অজুহাত দিলেও সেদিন কোন অজুহাতে কাজ হয় না। এলাকার একমাত্র পুরহিত দু’দিন আগেই স্বপরিবারে পালিয়ে গিয়েছে ভারতে। মন্দিরগুলো শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা শূন্যের মতো ভগ্ন হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে কারো অপেক্ষায়। শেষ পর্যন্ত নিষ্প্রাণ মন্দিরে যেয়ে ঠাকুরের সামনে কপালে সিঁদুর আর ভাটিফুল দিয়ে গাঁথা মালা বদল করে দু’জন দু’জনাকে আপন করে। আপন মাকে এসব কথা বললে তিনি সাবলীলভাবে নতুন বউকে ঘরে তুলে নেন। পরের দিন ভোর হবার আগেই আপন বেরিয়ে যায় মুক্তির টানে। আপনকে বিদায় দিতে মহিমার মন সাঁই না দিলেও সে আটকাতে পারে না। আপনের ওপর তার যেমন অধিকার, দেশ মাতার অধিকার তার চেয়েও বেশি। শুধু চোখের জল ফেলে ঠোঁট কাঁপাতে কাঁপাতে বলেছিল, “তোমার আসার প্রতীক্ষায় থাকবো আজীবন।” আপনকে বিদায় দিয়ে মহিমা গোপনে তার ঘরে এসে ওঠায় তার বাবা-মা কিছু জানতেই পারে না।
দিন যত যায় দেশের অবস্থা ততই খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে। মহিমার বাবা প্রথমে গ্রামে থাকতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত অনেকের মতো পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে অনেক কষ্টে ভারতে যেয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এখানে থাকা অবস্থায় মহিমার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন আসে। যা পরিবার তথা পুরো বংশের মুখে চুনকালি দেবার জন্যে যথেষ্ট। আপন তাকে মন্দিরে বিয়ে করেছে একথা জানালেও কোন কাজ হয় না। ভূবন কর্মকার এ বিয়ে মানে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। পেটের আগত সন্তান নষ্ট করার জন্যে মহিমার ওপর চাপ সৃষ্টি করলে কিছুতেই সে রাজী হয় না। মহিমা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, আগত সন্তানের পিতৃপরিচয় আছে। তার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনভাবে পতপত করে ওড়ে লাল সবুজের পতাকা। মহিমার শরীরের অবস্থা ভাল না বলে শরনার্থী শিবির থেকে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানেই সেজুঁতির জন্ম। ভূবন কর্মকার প্রথমে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে গ্রামের জায়গা জমি সব বিক্রি করে নারায়নগঞ্জ শহরে একটি বাড়ি কেনে। কিছুদিন পরে মহিমাদের সেখানেই নিয়ে আসে, যাতে কেউ জানতে না পারে সেজুঁতির জন্মবৃত্তান্ত। যদিও এখন সেজুঁতিই ভূবন কর্মকারের প্রাণ ভোমরা। স্বাধীন দেশে মহিমা আপনকে অনেকভাবে খুঁজেছে; পায়নি। গ্রামে গিয়ে জানতে পারে, যুদ্ধে আপনের পায়ে গুলি লেগেছিল। কিছুদিন হাসপাতালে থেকে গ্রামে ফিরেও এসেছিল। তার দাদা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। বাড়িতে পাক হানাদার বাহিনীরা আপনকে খুঁজে না পেয়ে তার বৃদ্ধ মাকে গুলি করে মেরে ফেলে। দাদা আর মায়ের মৃত্যুশোক সাথে মহিমার খোঁজ না পেয়ে কোথায় যেন চলে যায় আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬ শে মার্চে মহিমা একা একা গ্রামে যায় আপনের খোঁজে। যদি তার দেখা পায়।নীরবতা কাটিয়ে সেজুঁতি বলল, “তোমরা স্মৃতিচারণের বহু সুযোগ পাবে। বিয়েটা আগে সারা হোক। এই নাও সিঁদুরের কৌটা।” দু’জনের মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না। আনন্দে তাদের চোখ ছল ছল করে ওঠে। সেজুঁতি আবারো বলল, “আমি তোমাদের সব অতীত জানি। আর আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে বিয়ের আয়োজনটা করতেই হতো। আমি গর্বিত; আমি তোমাদেরই সন্তান।”“মা তুই যে.......” মহিমার কথা শেষ না হতেই সেজুঁতি বলল, “হুম ভালবাসি, অবশ্যই ভালবাসি। প্রথমদিন থেকেই আমার বাবার আসনে তাঁকে বসিয়ে রেখেছি। শুধু আজ আমার পূর্ণ অধিকার আদায় করে নিলাম।”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct