আপনজন ডেস্ক: রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তারাবিহর নামাজ পড়ে থাকেন। উত্তরপ্রদেশে বাড়িতে নামাজ পড়ায় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সে রাজ্যের পুলিশ। বজরং দলের পক্ষে বাড়িতে তারাবিহ নামাজ পড়ায় আপত্তি ওঠায় পুলিশ শান্তি রক্ষায় এই ব্যবস্থা নিচ্ছে। জানা গেছে, মোরাদাবাদের লাজপতনগর এলাকার একটি বাড়িতে কিছু লোক নামাজ পড়ছিল। হঠাৎ বজরং দলের কর্মীরা এসে নামাজ বন্ধ করে দেন। তারা বলে, ‘এই নতুন ঐতিহ্য শুরু হতে দেবে না তারা’। রমজান শুরু হয়েছে আর রাম নবমীর সময় পাছে পরিবেশ বিগড়ে যায়, তাই পুলিশও পৌঁছে যায়। প্রশাসন নামাজ পড়া ১০ জনকে নোটিশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যদি এমন পরিস্থিতি আবার দেখা দেয় তবে তাদের প্রত্যেককে ৫ লাখ টাকার জরিমানার বন্ড জমা দিতে হবে। এই ঘটনার সূত্রপাত একটি বাইরাল হওয়া ভিডিওকে কেন্দ্র করে। ওই ভিডিওতে নিজেকে রাষ্ট্রীয় বজরং দলের রাজ্য সভাপতি হিসেবে বর্ণনা করা রোহন সাক্সেনাকে দেখা যায়। তারা বলেন, ‘এখানে জাকির নামে এক ব্যক্তি আছেন, যিনি নতুন ঐতিহ্য স্থাপন করে অন্য লোকদের ডেকে নিজ বাড়িতে নামাজের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। যারা এ ধরনের ঝামেলা করবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।’ রোহনের আরও হুমকি, ‘শুধু মোরাদাবাদের লাজপতনগর নয়, আমরা রাজ্য বা দেশের কোথাও এটি হতে দেব না।’ শুধু মোরাদাবাদ নয়, নয়ডা এক্সটেনশনের সেক্টর ১৬বি-এর ইকো ভিলেজ-২ সোসাইটিতে গত ২৭ মার্চ ৩০-৪০জন মুসলিম রাত সাড়ে আটা নাগাদ বাজারের একটি খালি দোকানে নামাজ পড়ছিলেন। এই দোকানটি সোসাইটির বাণিজ্যিক মার্কেটের তৃতীয় তলায়। আশেপাশের বাসিন্দারা আপত্তি জানায় এবং পুলিশকে ফোন করে। পুলিশ এলে অভিযোগকারীরা বলেন, নামাজে কোনো সমস্যা নেই। তবে অন্য সমাজের অচেনা লোকজনের উপস্থিতিতে আপত্তি রয়েছে। এটা আমাদের নিরাপত্তার বিষয়। মুসলিম পক্ষ সম্মত হয় এবং তারপর নামাজ না পড়তে রাজি হয়। তবে মাতা কি চৌকিতে সমস্যা না হলেও নামাজে কেন আপত্তি আছে সেই প্রশ্ন তোলেন। আর একটি ঘটনা ঘটে ২৪ মার্চ। নয়ডার সেক্টর ১৩৭এ-সুপারটেক ইকোসিটি সোসাইটির এক মুসলিম বাসিন্দার বাড়িতে নামাজ পড়া হচ্ছিল। সমাজের লোকজনের সঙ্গে বজরং দলের কিছু লোক এসে প্রার্থনা বন্ধ করে দেয়। এই তিনটি ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মীদের নাম সামনে এসেছে। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয় তাতে দেখা যায়, একটি বাড়িতে নামাজ পড়া হচ্ছে এবং বজরং দল এর সদস্যরা বিরোধিতা করছে। পরে বিনা অনুমতিতে আবারও এ কাজ করায় পুলিশ বাড়ির মালিককে ৫ লাখ টাকার মুচলেকা দেয়। যদিও লাজপতনগর এলাকায় এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছে যেখানে সেখানে এখন নীরবতা বিরাজ করছে।
লাজপতনগরের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। হিসেব অনুযায়ী, এখানকার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ হিন্দু, আর ৩০ শতাংশ মুসলিম। অতীতে এখানে বাড়ি ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। দৈনিক বাস্করের এক সাংবাদিক স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি নামাজের বিরোধের কথা উল্লেখ করলেই তারা কথা বলতে রাজি হননি। তারা বলেন, আমরা এই বিশৃঙ্খলায় পড়তে চাই না। ক্যামেরা বন্ধ করার পর তিনি কথা বলতে রাজি হন। কিন্তু তারপরও তাদের নাম উল্লেখ না করার নির্দেশ দেন। ওই এলাকার এক হিন্দু বাসিন্দা বলেন, ‘যা হয়েছে, তা খুবই ভুল। এখন কি মানুষ তার ঘরে ইবাদত করতে পারে না? আমি একজন হিন্দু, কিন্তু আমি এভাবে নামাজ পড়তে না দেওয়ার বিরোধিতা করি। কিছু বহিরাগতরা অকারণে পরিবেশ নষ্ট করতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে, যার বাড়িতে নামাজ পড়া হচ্ছিল তার নাম জাকির হোসেন। যেখানে বিবাদ হয়েছিল, সেটি তার বাড়ি নয়, গোডাউন ছিল। সেখানে এখন তালা ঝুলছে। বাড়ির বাইরে একটা বড় লোহার গেট আছে, তার ওপর কিছু পোস্টার আছে, যা অর্ধেক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এসব পোস্টারে লেখা আছে, ‘রমজান মোবারক- তারাবীহ, এখানে তিন আয়াত পাঠ করা হবে, এশার নামাজ হবে সকাল ৮.১৫, ইনশাআল্লাহ।’ জাকির হোসেন একটি বড় লোহার দোকানের মালিক এবং এই বাড়িটিকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেন। বিতর্কিত স্থানটি তালাবদ্ধ ছিল, তাই আমি জাকিরের সাথে দেখা করতে তার বাড়িতে পৌঁছেছি। জাকির খুব রেগে গিয়ে প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি অভিযোগ করেন, মিডিয়া পুরো বিষয়টি দেখানোর পরিবর্তে মামলাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছে। তাদের আশ্বস্ত করার পর তারা কথা বলতে রাজি হন, ক্ষোভের সাথে বলেন- ‘প্রশাসনের নির্দেশ আমরা মেনে নিয়েছি, এখন আর এখানে তারাবিহ নামাজ পড়ব না।’ অতঃপর হতাশা থেকে জিজ্ঞেস করে, নামায পড়লে দোষ কোথায়? কাদের এ নিয়ে কোন সমস্যা আছে? জাকির হোসেন ব্যাখ্যা করেন, তার গোডাউনে যা ঘটছিল তা সাধারণ প্রার্থনার অনুষ্ঠান ছিল না । মুসলমানরা রমজান মাসে তারাবিহ নামাজ আদায় করে, যা ইসলামের একটি প্রাচীন রীতি। আমরা নতুন কোনো ঐতিহ্য শুরু করিনি। ব্যবসার কারণে মসজিদে যাওয়ার সময় নেই, তাই লোকেরা প্রায়শই তাদের বাড়িতে তারাবিহের নামাজের আয়োজন করে। মানুষ জড়ো হয়ে কুরআন পাঠ করে। জাকির আরও বলেন, আমাদের তারাবিহের কর্মসূচি ছিল ৯ দিনের, একই পোস্টার লাগানো হয়েছিল, যাতে সমস্ত অভাবী মানুষ অংশ নিতে পারে। শনিবার আচমকাই রাষ্ট্রীয় বজরং দলের লোকেরা এসে সব বন্ধ করে দিতে স্লোগান দিতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশও চলে আসে। আমরা পুলিশকে নামাজ শেষ করার অনুমতি দিতে বললে পুলিশ রাজি হয়। কিন্তু পরে আমাদের প্রত্যেককে ৫ লাখ টাকার বন্ড দেয়। লাজপতনগরের কাটঘর থানার সার্কেল অফিসার (সিও) শৈলজা মিশ্রের মিডিয়াকে দেওয়া বিবৃতি অনুসারে, শনিবার যখন পুলিশ পৌঁছল তখন পরিবেশ বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। জাকির হুসেন ঘটনাস্থলেই বলেছিলেন, এখন সেখানে তারাবির নামাজ হবে না। তবে শান্তি ভঙ্গের অভিযোগে গত ২৬ মার্চ উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। জাকির হুসেন এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুসলিম সম্প্রদায়ের ১০ জনের বিরুদ্ধে সিআরপিসি ১০৭/১১৬ ধারার (শান্তি ব্যাহত) অধীনে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে কেন এলাকায় ‘শান্তি বিঘ্নিত করার’ জন্য তাদের প্রত্যেককে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে না। তবে রাষ্ট্রীয় বজরং দল এবং তার লোকেরা নোটিশ পেয়েছে কি না, তার জবাবে পুলিশ বলছে যে প্রক্রিয়া চলছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct