তুর্কি নির্বাচন নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এরদোগানের প্রতিপক্ষ কামাল কিরিচদারুগলু কুর্দি দল এইচডিপির সাথে তাদের নিজস্ব প্রার্থী না দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতায় এসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। এই কৌশলের প্রতিবাদ এসেছে তার জোটের জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে। ইউরোপ আমেরিকান প্রভাবশালী জোটের সাথে বিরোধী প্রার্থীর একাত্ম হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এরদোগানের জনপ্রিয়তার পাল্লা আবার ভারী হতে শুরু করেছে। তুরস্ক নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
দিনের শেষে, এইচডিপির ১১-দফা অবস্থানপত্র এবং নেশন অ্যালায়েন্সের নীতি প্রস্তাবগুলো একটি নির্দিষ্ট সাধারণ ভিত্তি পূরণ করে। নিরপেক্ষ ট্রাস্টিদের নিয়োগ বন্ধ করা, স্থানীয় সরকারগুলোতে আরো ক্ষমতা বরাদ্দ করা এবং ডিক্রি দ্বারা সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে, পিকেকে এবং গুলেনিস্ট গ্রুপ পিপলস অ্যালায়েন্সের শপথ নেয়া শত্রু। তারা কিরিচদারুগলুকে জয়ী করতে সাহায্য করার জন্য তাদের ক্ষমতায় কুলায় এমন সব কিছু করবে বলে উপসংহারে পৌঁছানোর বিষয়টা বোঝার জন্য রাজনীতিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। আইপি চেয়ার মেরাল আকসেনার বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত বিরোধী জোটে ফিরে আসার আগে জোট ত্যাগ করার সময় অনুরূপ কথা বলেছিলেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি নীরব ছিলেন, যা কৌতূহলের জন্ম দেয়। আগিরালিওলুর মন্তব্য এইচডিপির সাথে বিরোধী ব্লকের গোপন লেনদেনের প্রতি আপত্তি তুলে ধরে। তিনি এর মাধ্যমে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছিলেন। সবচেয়ে আপসহীন বিবৃতিগুলোর মধ্যে একটি এইচডিপি সদস্য আহমেত তুর্কের কাছ থেকে এসেছে। তিনি বলেন, ‘যে কেউ এই সরকারকে সমর্থন করে তারা কুর্দি জনগণের প্রতি শত্রুতা করছে। কোনো কুর্দির এই সরকারকে ভোট দেয়ার বা সমর্থন করার অধিকার নেই।’ তিনি যুক্তি দেন যে এরদোগানকে ভোট দেয়া অগ্রহণযোগ্য অথচ তিনি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে কুর্দি পরিচয়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল সংস্কার করেছিলেন। তুর্কের এই বিবৃতি পিকেকে-এইচডিপির সর্বগ্রাসী জাতীয়তাবাদের একটি মূর্ত প্রতীক। তুরস্কের নির্বাচন ঘিরে বিদেশি প্রভাব দেশটির অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্ট ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকানের ছেলে ফাতিহ এরবাকানের দল নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির পিপলস জোটে যোগদান তারই একটি ইঙ্গিত বলে মনে হয়। তুর্কি দৈনিক ইয়েনি সাফাকের সাবেক প্রধান সম্পাদক ইব্রাহিম কারাগুল টুইট বার্তায় লিখেছেন, এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক জেঙ্গেজুর করিডোরের মাধ্যমে আনাতোলিয়া এবং মধ্য এশিয়াকে সংযুক্ত করছে। ইরাকের সম্মতিতে এটি তুরস্ককে পারস্য উপসাগরের সাথে সংযুক্ত করছে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই প্রকল্পে অংশ নেবে। যখন বিরোধিরা তুরস্ককে বিচ্ছিন্ন করার ‘মানচিত্র’ এর পরিকল্পনা তৈরি করছে, তখন সরকার তুরস্কের নতুন সিল্ক রোড খুলেছে।
কারাগুল মনে করেন, কিরিচদারুগলু নির্বাচিত হলে; সিরিয়া ও ইরাক তুরস্কের ওপর আক্রমণ শুরু করবে। ইরান ও আর্মেনিয়া আজারবাইজান আক্রমণ করবে। লিবিয়া ও সিরিয়া থেকে তুর্কি সেনাদের প্রত্যাহার করা হবে। তুরস্ক রাশিয়ার সাথে প্রকাশ্য যুদ্ধে ধাবিত হবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পরিকল্পনা। এরই এখন প্রস্তুতি চলছে। কারাগুলের এই পর্যবেক্ষণ কিছুটা প্রান্তিক মনে হতে পারে তবে পররাষ্ট্র কৌশল এবং তুরস্কের আঞ্চলিক ভূমিকা দেশটির অনেক ভোটারকে প্রভাবিত করে। যারা এরদোগানের রক্ষণশীলতা অপছন্দ করে তাদের অনেকে মনে করেন তুরস্কের অখণ্ডতা এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে এরদোগানের বিকল্প এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে এরদোগানের পক্ষে জনমত আবার বাড়তে শুরু করেছে। তুর্কি বিশ্লেষক ইহসান আকতাস এর মতে, সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো ২১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বর্তমানে নির্বাচনে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। এরদোগান আগের নির্বাচনে ৫১.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হোমল্যান্ড পার্টির (এমপি) চেয়ারপারসন মুহাররেম ইনসকে ২২ পয়েন্টের লিড দিয়ে পরাজিত করেছিলেন। এ কারণে প্রধান বিরোধী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) চেয়ারপারসন কামাল কিরিচদারুগলুর নেতৃত্বে গঠিত ‘ছয়ের টেবিল’ এ এরদোগানবিরোধী সব উপাদানকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, শরণার্থী-বিরোধী ফ্যাসিস্ট, মধ্যপন্থী মুসলিম, উগ্র-বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদীদের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একই ‘টেবিলে’ একত্রিত হয়েছে। সর্বশেষ, ‘টেবিল’-এ বিচ্ছিন্নতাবাদী পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সহযোগী হিসেবে পরিচিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি) অন্তর্ভুক্ত হয়। তদুপরি, কিরিচদারুগলু ‘টেবিল’ আমন্ত্রিত প্রত্যেক অভিনেতাকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই ডেপুটিদের (ইতোমধ্যে সাতটিতে পৌঁছেছে-ভবিষ্যতে আরো প্রত্যাশিত) জিজ্ঞাসা না করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি পা রাখতে পারবেন না। নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা ফাতিহ এরবাকান এ কারণে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে সাতজন ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। আপনি রাষ্ট্রপতির সাথে আট-মাথার ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। এটি একটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা, একটি হযবরল ব্যবস্থা।’
শুধু সংখ্যার খেলা নয় এই সব ছাড়ের কারণ হলো সরল পাটিগণিতের ওপর ভিত্তি করে: যখন অভিনেতাদের আনুমানিক ভোট একত্রিত করা হয় তখন তারা হিসাব করে যে তাদের যৌথ প্রার্থী কিরিচদারুগলু এরদোগানকে পরাজিত করবেন। কাগজ-কলমে জোটের সাফল্যের সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে তা টিকবে কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়। গণতন্ত্র ‘শুধু একটি সংখ্যার খেলা’ নয় এবং জোটে কিছু অভিনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিক্রিয়াও ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে।উদাহরণস্বরূপ, ‘টেবিলে’ তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের প্রতিনিধিত্বকারী মেরাল আকসেনার তার দল, গুড পার্টি (আইপি) ও তার সমর্থকদের বিতর্কিত এইচডিপির সাথে জোট গঠনে রাজি করাতে চড়াই-উৎরাইয়ের মুখোমুখি হন। তার সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহের কারণে জোট ত্যাগ করা সত্ত্বেও, আকসেনার অবশেষে পুনরায় যোগ দিতে রাজি হন। তবে, তার দল এবং সমর্থকরা সন্তুষ্ট হননি, অনেকেই ছাড় পেয়ে অপমানিত বোধ করছেন। এর ফলে, জাতীয়তাবাদীরা ইন্সের প্রতি তাদের সমর্থন স্থানান্তরিত করেছে, যিনি বিরোধী জোট থেকে আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি পদে তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন। বর্তমানে, ভোটে ইন্সের সমর্থন প্রায় ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, বিরোধী ব্লক রাষ্ট্রপতি এরদোগানকে পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেয়ার জন্য আইনি উপায়ও খুঁজছে। তারা এরদোগানের প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার জন্য সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলকে (ওয়াইএসকে) চাপ দিচ্ছে, কিন্তু সংবিধান স্পষ্ট করে যে তার প্রার্থিতার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই। এরদোগানের প্রার্থিতা রোধ করার এই মরিয়া প্রচেষ্টা ‘ছয়ের টেবিল’-এর ব্যর্থতা প্রকাশ করে যা তাকে ব্যালট বাক্সে পরাজিত করার ক্ষেত্রে আস্থাশীল নয় বলে প্রমাণ করে। এই অসহায়ত্ববোধ এবং যুথসই কৌশলের অভাবে বিরোধী ভোটারদের হতাশা বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করেছেন তুর্কি বিশ্লেষক বুরহানুদ্দিন দুরান। তিনি মনে করেন, ভোটাররা একটি অস্থির অঞ্চলে তুর্কিয়ের ক্ষমতা, অখণ্ডতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার গুরুত্ব বোঝেন, তারা বুঝতে পারবে যে সঙ্কটের সময়ে, দেশটি কোনো অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেয়া বা বেপরোয়া দুঃসাহসিক কাজে জড়িত হতে পারে না। ফলে আগামী নির্বাচনে তাদের পছন্দের কোনো পরিবর্তন হবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct