কালা বুড়ি
আব্দুর রহমান
“বৌ মা যাও। পাতাগুলো বরং আমি ছাড়িয়ে নেই।” কথাটা বলেই এক গোছা সজনে পাতার ডাল নিয়ে একটি মোড়ায় বসলো শিমুলের মা। আজ যার বয়স একষট্টি চলছে। বয়সের সাথে চোখের শক্তিও কমেছে। তাইতো চশমাটা সব সময় চোখে থাকে। বাম কানটাতে সেই ছোট্ট বেলা থেকে কম শোনে। হয়তো না শোনার একটা ইতিহাসও আছে। তবে সেটা কাউকে বলেনা। অবশ্য ছোট্ট নাতি ময়না ও রাকিব খুব করে শুনতে চায়। তাইতো আদর করে দুই নাতিকে গালে দুটি চুমো এঁকে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং অনেক অনেক দোয়া করে দেয় - আর তাতেই এক সময় আবদারটা ভুলে যায় ফুটফটে বাচ্চা দুটি। কিন্তু একটি নাম ওরা জানে। ওদের বাড়ীটাকে সবাই কালা বুড়ীর বাড়ী বলে । আর কালা বুড়ীটা যে ওর দাদী সেটা ওরা বুঝতে পারে। তবে ওদের দাদীতো দেখতে কালো নয়। তাই রহস্যটুকু জানার ইচ্ছা ওদের মনে ঘুরপাক খেতেই থাকে। আজ রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে। শিমুল, বউ মা আর ফুটফুটে দুই নাতি। সজনে শাক ভাজিটার সবাই খুব প্রশংসা করলো। তাইতো শাশুরী হিসেবে বউ মায়ের প্রশংসা করতে একটুও ভুল করলেননা শিমুলের মা। কারণ ভাজিটা বউ মাই করেছে। ময়না বললো বাবা জানো, “আমাদের বান্ধবী টিকলী রোজ রোজ স্কুলে গল্প শোনায়। কিন্তু আমি কোন গল্প বলতে পারি না।” বাবা বললো, “কেন? ঠিক আছে এখন থেকে তুমিও শোনাবে।”- ও তো দাদীর কাছ থেকে শিখেছে। কিন্তু, আমার দাদীতো কোন গল্প বলেনা বাবা। শিমুল বললো, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই মা মনি। এবার দাদী বললো,”থাকনা বাবা। ঠিকইতো বলেছে। আমিতো ওদের কখনও গল্প শোনাইনি। তাহলে আসো দাদু আজ একটি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাই। যেহেতু এখন মার্চ মাস। কী শুনবে?
অবশ্যই শুনবো দাদী। -১৯৭১ সালে একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। যে তার বাবার খুব আদুরে ছিল। বাবাকে ছাড়া খেতোনা, গোসল দিতোনা এমনকি ঘুমাতোও না। তাই বাবার বুকে রোজ রোজ ঘুম পাড়তো। আর বাবাও তাকে আদর করে বুড়ী বলে ডাকতো। অবশ্য বুড়ীর মা প্রায়ই বলতো, মেয়েটাকে এতো আদর দিয়োনা। তাহলে একসময় সে মাথায় উঠবে বলে রাখছি। আর বুড়ীর বাবা বলতো চুপ থাকোতো, ও কী বুঝে ছোট মানুষ! তারপর একাত্তরে ভয়াবহ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো! বুড়ির বাবাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিল। পেশায় ছিলেন তিনি একজন শিক্ষক। পাড়ার সকল যুবক, বৃদ্ধ, দিন মজুর তাঁর কথা মতো যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই খবরটা আবার পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। এমনকি হানাদারদের কানেও। তারপর..। ময়না বললো, তারপর কী বলোনা দাদী। তারপর ওদের বাড়ীতে একদিন রাতের বেলা রাজাকাররা মিলিটারি নিয়ে এলো! ওরা সবাই একসাথে আমাদের মতো এই রকম বসে রাতে খাবার খাচ্ছিলো। গাড়ীর আওয়াজ পাওয়ার পর ওর বাবা পাশের ঘরে লুকিয়ে পড়লো। মিলিটারিরা জিজ্ঞেস করতেই বুড়ীর মা জানালো, ওর বাবা বাড়ীতে নেই। তাই ওরা হুমকি দিয়ে ফিরে আসছিল। কিন্তু, একজন রাজাকার এসে তিন বছরের ছোট্ট বুড়ীকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল। “তোমার বাবা কোথায় মা মনি?” বুড়ির মা বললো, বললামতো সে বাড়ীতে নেই। তারপরও আপনারা ওকে বিরক্ত করছেন কেন! ও ছোট্ট মানুষ এমনিতেই ভয় পাচ্ছে! এবার চঞ্চল বুড়ী বললো, না মা তুমি মিথ্যা বলছো কেন। আমার কোন ভয় লাগছেনা।কাক্কু আমার বাবা পাশের রুমেই আছে। তারপর বুড়ির বাবাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হলো! বাবার তাঁজা রক্ত দেখে, রাজাকারের হাত কামড়ে ধরলো তিন বছরের বুড়ি। আর সাথে সাথে ওর বাম কানে একটা জোড়ে থাপ্পর মারলো রাজাকারটা। আর সে থেকেই আজও সেই বাবার অতি আদুরে বুড়ীটি কানে শোনেনা। বাবাকেতো হারালো সাথে হারালো কানটাও! আর সেই মেয়েটি কে জানতে চাও দাদু ভাই? কে সে দাদী? আমিই সেই কালা বুড়ি যে তোমাদের দাদী, বলে দু’চোখের জল ছেড়ে দিলো ..।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct