ফলাফল
গোলাম মোস্তাফা মুনু
‘বউমা, বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই; এমন পরিবেশে বাইরে থেকে কোনো ব্যাটাছেলে বাড়ির মধ্যে এসে তোমার মেয়েকে টিউশন পড়াচ্ছে, এটা আমার ভালো লাগে না। মেয়েটা তো আর ছোট নয়! চৌদ্দ বছর পার হয়ে গেছে।’ এ বলে শাশুড়ি কমলা বেওয়া ব্যাগ থেকে শাক বের করে কুলাতে নিয়ে বাছতে শুরু করেন। শাশুড়ির কথা শুনে বউমা খানিক রেগে যায়। ক্রুদ্ধস্বরে বলে, ‘তোমার এত বয়স হয়ে গেল তবুও মনটাকে পরিষ্কার করতে পারলে না। এত খারাপ মন-মানসিকতা নিয়ে থাকা কি ভালো! মাস্টারটা ভালো মানুষ। পড়ায়ও ভালো। এতদিন থেকে পড়াচ্ছে, কোনোদিন তো ওর খারাপ কিছু দেখিনি!’ ‘প্রতিদিন তো আর খারাপ কিছু ঘটে না। মুহূর্তের মধ্যেই অঘটন ঘটে যেতে পারে। আর শোনো বউমা, পরপুরুষের সামনে কোনো মেয়ে মানুষের বসে থাকা আমাদের ইসলাম ধর্মে বৈধ নয়। ফলে আমি আর এটা মেনে নিতে পারছি না।’ কমলা বেওয়া শাক বাছতে বাছতেই কথাগুলো বললেন। বউমা চুমকি বিবি শাশুড়ির কথায় খুব রাগ করে। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করে না। মনে মনে। খানিক পরেই নিজের ঘরে গিয়ে স্বামীকে ফোন করে। স্বামী তখন দূর বিদেশে কর্মরত। স্ত্রীর কথা শুনে মায়ের প্রতি নাফির আলীর রাগ হয়। ফোন মারফত স্ত্রীকে সে বুঝিয়ে বলে, ‘মায়ের সাথে তুমি আর কথা কাটাকাটি করবে না। কারণ, পাড়া-প্রতিবেশীর লোকেরা আমাদের মন্দ ভাববে। এখানে আরো দু’মাসের কাজ ছিল, কিন্তু আর করবো না। দিন দশেক পরেই আমি বাড়ি ফিরে যাবো। বাড়ি গিয়ে আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে দেবো। চুমকি, তুমি আর মাথা গরম করো না।’
স্বামীর কথা শুনে চুমকি যেন খুশি হতে পারল না। তার মনের মধ্যে এক রকম অশান্তি শুরু হয়ে গেল। সব সময় মন খারাপ করে থাকে সে। শাশুড়ির সামনে দ্বিগুণ মন ভারী করে থাকে। কিন্তু সে মাস্টারের নজরে হাসিখুশিই থাকে। এভাবে দিন দশেক পার হয়ে যায়। স্বামী বাড়ি ফিরে। নাস্তা-পানি খেয়ে স্বামী-স্ত্রী একটা বিশেষ আলোচনা সেরে নেয়। তারপর মায়ের ঘরে গিয়ে নাফির আলী মাকে বলে, ‘মা, আমি বুঝতে পারছি তুমি মাস্টারকে সহ্য করতে পারছো না। কিন্তু তোমার পোতির পরীক্ষা পর্যন্ত ওই মাস্টারের দরকার আছে। তুমি ততদিন তোমার মেয়ের বাড়ি থাকো। বোনকে আমি ফোনে জানিয়ে দিয়েছি। ওখানে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।’ ছেলের মন-মানসিকতা বুঝে মা খুব দুঃখ পান। তিনি শান্ত স্বরে বলেন, ‘ওরে নাফির, মা কি কোনোদিন ছেলের খারাপ চায়! আমি তো তোর মঙ্গলের কথায় ভাবছিলাম রে বাবা। যাই হোক, তুই আর তোর স্ত্রী হয়তো একটু বেশি বুঝে ফেলেছিস। কিন্তু এগুলোর ফলাফল ভালো হয় না। ঠিক আছে, তুই আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, আমি আজই চলে যাচ্ছি।’ বলে সেদিনই মা চলে যান মেয়ের বাড়ি। সপ্তাহখানেক পর। খুব সকাল সকাল চুমকি বিবি যায় বাবার বাড়ি। পাশের গ্রামেই। মা নাকি অসুস্থ। আর নাফির আলী সকালের নাস্তা খেয়ে নিজের কাজে বের হয়। সারাদিন কাজ-কাম করে বিকেল বেলায় ক্লান্ত শরীরে সে বাড়ি ফিরে। চুমকি তখনো বাবার বাড়ি থেকে ফেরেনি। নাফির মেয়েকে নানার বাড়ি পাঠায় তার মাকে ডেকে আনার জন্য। ঘন্টাখানেক পর মেয়ে বাড়ি ফিরে বাবাকে জানায়, ‘আম্মা তো নানার বাড়িতে নেই আব্বা! মা নাকি সকালেই সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে!’ বিস্ময়ের সুরে নাফির আলী বলে, ‘আশ্চর্য!বাড়িও তো ফিরেনি! তাহলে গেল কোথায়?’ স্ত্রীর বাড়ি না ফেরার বিষয় নিয়ে নাফির খুব চিন্তিত। চিন্তিত মেয়েও। মেয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলে। এমন সময় তাদের বাড়ি আসে প্রতিবেশী এক যুবক। এসেই সে নাফিরকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওর মা কি বাড়ি ফিরেছে? মনে হয় ফেরেনি। আজকে আমি শহরে গিয়েছিলাম। দশটা-এগারোটার দিকে ওর মাকে দেখলাম, তোমাদের মাস্টারের সাথে মোটরসাইকেলে চেপে...!’ যুবক কথা আর আগে বাড়ালো না। থেমে গেল। নাফির আলী যুবকের কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পায়। মুখ নীচে করেই সে পুনরায় চুমকির নম্বরে ফোন লাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আবারও চুমকির মোবাইল ফোন বন্ধ। বন্ধ মাস্টারের মোবাইল ফোনও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct