মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠনের ১০০ দিন পেরোতে না পেরোতেই আবারো সরকারে অস্থি’রতার গুঞ্জন উঠেছে। বিরোধী জোট পেরিকাতান ন্যাশনালের প্রধান শরিক দল পাসের প্রধান আব্দুল হাদি আওয়াং বলেছেন, যেকোনো সময় বর্তমান সরকার ভেঙে পড়তে পারে। সরকার পক্ষ হাদির এই কথাকে গুরুত্বহীন হিসেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বিরোধী জোটের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
এক সময় সংখ্যাগুরু ৬৩ ভাগ জনগোষ্ঠী মালয়দের প্রতিনিধিত্বশীল প্রধান দুই দল ছিল উমনু এবং পাস। উমনু স্বাধীনতার পর থেকে মালয়েশিয়ার সরকারে নেতৃত্ব দিয়েছে। পাকাতান হারাপানের প্রথম সরকার গঠন পর্যন্ত উমনু ক্ষমতায় ছিল। অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মাহাথিরের নেতৃত্বে বারাসাতু নামে নতুন দল গঠন করে বিরোধী পাকাতান হারাপানের সাথে নির্বাচন ও সরকার গঠনের পর মালয় দল হিসেবে সমর্থন উমনু ও বারাসাতুর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এ বিভক্তিতে অন্য মালয় দল পাস মালয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক সমর্থন তৈরিতে সক্ষম হয়। বিগত নির্বাচনের ফলাফল এরই প্রতিফলন।মালয় জনগোষ্ঠীর দল হিসেবে উমনুর প্রভাব কমার পেছনে বারাসাতু চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ইয়াসিনের সরকারে যোগদানকেও দায়ী মনে করা হয়। আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপানের সাথে বারিসানের যোগদানের পেছনে এটিকে প্রধান যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। এ ব্যাপারে জাহিদ-হাসান সমর্থকদের যুক্তির সামনে ইসমাইল সাবরি ও হিশামুদ্দিনের যুক্তি দলের মাঠ নেতাদের সামনে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এর ফলে দলের নীতি নির্ধারকদের বৈঠকে উমনু প্রধান জাহিদ হামিদী ও দলের উপপ্রধান মোহাম্মদ হাসানের পক্ষ উমনুর তৃণমূল নেতৃত্বের সমর্থন লাভ করে। পরবর্তীতে উমনুর নেতৃত্ব নির্বাচনে দলের প্রধান ও উপপ্রধান পদে ভোট অনুষ্ঠান না করার প্রস্তাবে জাহিদ-হাসানের প্রতিপক্ষ সাবরি-হিশামের বিরোধিতা ব্যর্থ হয়। দলের অন্যান্য পদে সাম্প্রতিক নির্বাচনেও ভিন্ন মতাবলম্বী সাবরি-হিশামপন্থী হিসেবে পরিচিতরা সাফল্য লাভ করেনি। এমনকি তারা ঐক্য সরকারের এই সময়ে উমনু এমপিদের একটি অংশকে পক্ষ ত্যাগে সংগঠিত করার একটি উদ্যোগ নিয়েও খুব একটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এই পটভূমিতে মহিউদ্দিন-হাদির নতুন সরকারের পতন পরিকল্পনা উমনুর মূলধারার সমর্থন কতটা পাবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যেতে পারে। যদিও মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন শরৎকালের মেঘের আনাগোনার মতোই। কখন কি হয় আভাস দেয়া মুশকিল। তবে উমনু আবারো যদি ‘শেরাটন মুভ’-এর মতো কোনো উদ্যোগে যুক্ত হয়ে যায় তবে মালয় জনগোষ্ঠীর দল হিসেবে তারা পাস-বারাসাতু অক্ষের কাছে প্রাসঙ্গিকতা আরো হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি অবশ্য দৃঢতার সাথে আশ্বস্ত করেছেন যে বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) এর সাথে নতুন উমনু নেতৃত্ব ফেডারেল পর্যায়ে জোট সরকারকে সমর্থন ও শক্তিশালী করা অব্যাহত রাখবে।
প্রশ্ন হল, এসব বাস্তবতার পরও আনোয়ার ইব্রাহিমের সরকার কি সত্যি সত্যি কোনো পতন আশঙ্কার হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ প্রশ্নের জবাব হলো জোরালো কোনো হুমকি এখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মালয়দের আস্থা অর্জন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এর মধ্যে ড. মাহাথির এই বয়সে আবার একটি সক্রিয়তাবাদী মালয় বলয়ে যোগ দিয়েছেন। তিনি আনোয়ারের চার মাসের সরকারকে স্বৈরাচার আখ্যা দিয়েছেন। এ নিয়ে অবশ্য শতবর্তী এই নেতাকে সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ ট্রলের শিকার হতে হয়েছে।আনোয়ারের রাষ্ট্র পরিচালনার একটি দর্শন আছে যেটি এখনো মালয় জনগোষ্ঠীর বড় অংশ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। সেটি হলো মালয়েশিয়াকে এগিয়ে যেতে হলে দেশটির সব জাতিতাত্তিক জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে এগুতে হবে। সব জনগোষ্ঠীর জন্য ভারসাম্যমূলক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মালয় নেতাদের বড় অংশ মনে করে মালয়েশিয়া হলো মূলত মালয়দের। চীনা ও ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা পরে এখানে বসতি শুরু করেছেন। ফলে মালয়েশিয়ার আদিবাসী হিসেবে মালয়দের বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মতো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও মালয়রা হারাবে। মালয় শাসকদের অধিকাংশই এই মতোই সমর্থন করে বলে মনে হয়। এ কারণে আনোয়ার ইব্রাহিম ক্ষমতার একেবারে কাছে গিয়ে বার বার ছিটকে পড়েছেন। এবার চীনা বংশোদ্ভূতদের দল ডিএপির ভূমিকা সরকারে গৌণ। আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব প্রক্রিয়ার মালয়দের প্রাধান্য রয়েছে। কিন্তু এরপরও পাসের একটি বড় প্রচারণা হলো মালয় স্বার্থ এখন ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাসের কিছু এনজিওকে নির্বাচনপূর্ব সময়ে ভোটে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আনোয়ারের সমলোচনাকে পাসের নেতারা মালয়বিরোধী মনোভাব হিসেবে প্রচার করছেন। মালয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূর এবং নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে ফেলার ব্যাপারে আনোয়ার সফল হলে এসব প্রচারণা খুব একটা কাজ করবে না। আগামী রাজ্য নির্বাচনগুলোতে এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। ছয় রাজ্যের আসন্ন এই নির্বাচনে শাসক জোটের যেকোনো ব্যর্থতা নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সরকারের উত্থান পতনের এই ধরনের অস্থিরতা মালয়েশিয়াকে আবারো দুর্বল করার দিকে ঠেলে দেবে। দেশটির মালয় শাসকদের, বিশেষ করে গভীর ক্ষমতা বলয়ের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে একটি বড় সিদ্ধান্তকারী পরিস্থিতি নিয়ে আসতে পারে। এবার সরকারে আনোয়ার ইব্রাহিমের সাফল্য পাকাতানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ দফায় ক্ষমতার চক্র থেকে ছিটকে পড়লে আনোয়ারের নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও যথেষ্ট তমসা চ্ছন্ন হয়ে পড়তে পারে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct