মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠনের ১০০ দিন পেরোতে না পেরোতেই আবারো সরকারে অস্থি’রতার গুঞ্জন উঠেছে। বিরোধী জোট পেরিকাতান ন্যাশনালের প্রধান শরিক দল পাসের প্রধান আব্দুল হাদি আওয়াং বলেছেন, যেকোনো সময় বর্তমান সরকার ভেঙে পড়তে পারে। সরকার পক্ষ হাদির এই কথাকে গুরুত্বহীন হিসেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। বিরোধী জোটের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
আনোয়ারের সরকার প্রাথমিক ১০০ দিনে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি তৈরিতে যথেষ্ট কাজ করে গেছেন। দেশী বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের সরকারের সময় রিংগিতের মান ও শেয়ার বাজারে যে অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা এখনো পুরোপুরি সফল না হলেও দাম বৃদ্ধির প্রবণতা এখন নেই। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর প্রতীকী উদ্যোগ হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম পুত্রজায়া লাইন ১৬ মার্চ খোলার দিন থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ব্যবহারকারীর জন্য ভাড়া না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ধরনের আরো কিছু উদ্যোগ তিনি নিতে পারেন। তবে এর পাশাপাশি বিরোধী জোটের দলগুলো নৃতাত্ত্বিক সংবেদনশীলতাকে উসকে দিয়ে নির্বাচনে সাফল্য অর্জনের যে কৌশল হাতে নিয়েছিল সেটি রোধে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে সরকার এখনো সফল হয়নি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটি হবে ছয়টি রাজ্যের আঞ্চলিক নির্বাচনে। আগামী আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কেলানতান, তেরেঙ্গানু, কেদাহ, নেগেরি সেম্বিলান, সেলাঙ্গর ও পেনাং-রাজ্যে নির্বাচন হবার কথা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি রাজ্যে বিরোধী জোটের সরকার রয়েছে। শেষোক্ত তিন রাজ্যে রয়েছে সরকারি জোটের সরকার। প্রথম তিনটি রাজ্য হলো মালয়প্রধান। এর মধ্যে কেলানতান ও তেরেঙ্গানুতে নিশ্চিতভাবে বিরোধী পক্ষের জয়ী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে কেদাহতে একসময় পাকাতান হারাপানের সরকার ছিল। রাজ্যের চিফ মিনিস্টার ছিলেন ড. মাহাথির মোহাম্মদের পুত্র মুখরিজ মাহাথির। পাকাতানের ফেডারেল সরকারের পতন ঘটার পর সেখানেও পাকাতান সরকারের পতন ঘটে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে এই রাজ্যে পেরিকাতান প্রার্থীরা বেশি সাফল্য পেয়েছেন। পেরিকাতান ন্যাশনালে (পিএন) যোগ দিতে মুখরিজের দলের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে পিএন হাইকমান্ড।
প্রধানমন্ত্রীর আভাস অনুসারে সামনের রাজ্য নির্বাচন ক্ষমতাসীন জোট সরকারের দলগুলো একসাথে করলে পূর্বাঞ্চলীয় কেলানতান ও তেরেঙ্গানুতে সরকার গঠনের মতো না হলেও সরকার পক্ষের আসন সংখ্যা বাড়তে পারে। আর কেদাহতে সরকার গঠন করার মতো একটি অবস্থান সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ পেনাং সেলাঙ্গর ও নেগরি সেম্বিলানে ভালো করার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা শুরু করেছে। মিশ্র জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য থাকা এই সব রাজ্যে সরকারের সাফল্য পাওয়া স্বাভাবিক। এর যে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে বিরোধী পক্ষের ফেডারেল পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা জোরালো হতে পারে। এদিকে মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। মুহিউদ্দিন তার পার্টি বেরসাতুর ঘুষের ২৩২.৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত (৫১.৪ মিলিয়ন ডলার) পেতে তার ক্ষমতার অপব্যবহারের চারটি এবং ১৯৫ মিলিয়ন রিংগিত (৪৩ মিলিয়ন ডলার) অর্থ পাচারের দুটি অভিযোগ এনেছে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন (এমএসিসি)। কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন মালয় ঠিকাদারদের অর্থনৈতিক উদ্দীপনা কর্মসূচির বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এমএসিসি মুহিউদ্দিনকে তলব করার পরে এই অভিযোগগুলী আসে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জামিনে মুক্তি পাওয়ার আগে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে, মুহিউদ্দিনকে প্রতিটি দুর্নীতির অভিযোগের জন্য ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থ পাচারের প্রতিটি ঘটনার জন্য ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব দেয়া মুহিউদ্দিন এখন অফিস ছাড়ার পর অভিযুক্ত দেশটির দ্বিতীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অফিসে থাকা প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ওয়ানএমডিবি দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার জন্য ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার প্রাক্কালে এই অভিযোগ আনা হয়। মুহিউদ্দিন সাংবাদিকদের কাছে তার গ্রেফতারকে ‘নিপীড়ন’ এবং আসন্ন রাজ্য নির্বাচনের আগে তার পেরিকাতান ন্যাশনাল (পিএন) বিরোধী জোটকে বাধা দেয়ার জন্য পরিকল্পিত একটি ‘বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই হিসেবে, অভিযোগগুলো এই বছরের রাজ্য নির্বাচনে রাজনৈতিক তাপ বাড়াতে পারে। আর এতে পেরিকাতান ন্যাশনাল জোটের দুই অংশীদার বারসাতু ও ইসলামিক দল পাস জাতিগত মালয় অস্থিরতার বিষয়ে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়বে। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রচার হলো আনোয়ারের বহু-জাতিগত জোট মালয়েশিয়ার সমাজে মালয় বিশেষাধিকার এবং ইসলামের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে আগ্রহী। আনোয়ারের জোট সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো সংখ্যাগুরু মালয়দের আস্থা অর্জন করা। আনোয়ারের নিজ দল পিকেআর এবং তার জোট পাকাতান হারাপান মালয় অধ্যুষিত অঞ্চলে ভালো করতে পারেনি। মালয়দের মধ্যে আনোয়ারের সমর্থন বেশি নয় বলে মনে করা হয়। যদিও ১৫তম সাধারণ নির্বাচনের পরে দ্বিতীয় মাসে পরিচালিত মারদেকা সেন্টারের একটি জরিপে সরকারের পক্ষে ইতিবাচক রেটিং পাওয়া যায়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এই জরিপ অনুসারে এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের রেটিং ছিল ৬৮ শতাংশ আর সরকারের অনুমোদন হার ছিল ৫৪ শতাংশ। তবে এই জরিপের তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হলো, ৬৭ শতাংশ জাতিগত ভারতীয়, ৬৫ শতাংশ জাতিগত চীনা, ৪২ শতাংশ মালয়দের কাছ থেকে সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মারদেকা সেন্টারের সাম্প্রতিক এই জরিপে বোঝা যায়, জাতিগত মালয়রা বর্তমান সরকারকে কম সমর্থন করেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct