২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির দিল্লির দাঙ্গা। এই দাঙ্গার সঙ্গে ১৯৮৪-র ওই ব্যাপক গণহত্যার তুলনা করা যায় না। এবার নিহতরা উভয় সম্প্রদায়ের। কিন্তু আসলে সরকারি হলফনামা অনুযায়ী, এই দাঙ্গায় নিহত ৫৩ জনের মধ্যে ৪০ জনই মুসলমান, আহতদের বেশিরভাগ এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও দোকানপাটের তিন-চতুর্থাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের। অর্থাৎ এই হিংসা কমবেশি একতরফা ছিল। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল এই সহিংসতার জন্য গ্রেফতার হওয়া অর্ধেকের বেশি মুসলমান! এ নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব।
১৯৮৪ সালে দিল্লিতে শিখ গণহত্যার পর মানবাধিকার সংস্থা পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ (পিইউসিএল) এবং পিপলস ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস (পিইউডিআর) এর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে গণহত্যার সত্যতা দেশের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, যা তৎকালীন শাসকরা চেয়েছিলেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুলদীপ নায়ার, রজনী কোঠারি এবং গোবিন্দ মুখোতির মতো নাগরিকরা এই হিংসার শিকার হওয়া মানুষদের বিবৃতি রেকর্ড করেন এবং হিংসার জন্য যারা দায়ী তাদের নাম প্রকাশ করেন। ঐতিহাসিক এই দলিলের কারণে আজও সেই সময়ের বড় বড় নেতারা ওই গণহত্যার অপরাধী বলে বিবেচিত হন। যে সত্য আদালত ও বিচারক কমিশন বলতে পারেনি, নাগরিকদের তৈরি এই প্রতিবেদন তা দেশের সামনে তুলে ধরেছে। একই পরম্পরায় সম্প্রতি আর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ্যে এসেছে। এই প্রতিবেদনের বিষয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া দিল্লির দাঙ্গা। এই দাঙ্গার সঙ্গে ১৯৮৪-র ওই ব্যাপক গণহত্যার তুলনা করা যায় না। এবার হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষ থেকেই হিংসার ঘটনা সামনে আসে। নিহতরাও উভয় সম্প্রদায়ের। কিন্তু আসলে সরকারি হলফনামা অনুযায়ী, এই দাঙ্গায় নিহত ৫৩ জনের মধ্যে ৪০ জনই মুসলমান, আহতদের বেশিরভাগ এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও দোকানপাটের তিন-চতুর্থাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের। অর্থাৎ এই হিংসা কমবেশি একতরফা ছিল। কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল এই সহিংসতার জন্য গ্রেফতার হওয়া অর্ধেকের বেশি মুসলমান! দিল্লি দাঙ্গার এই সত্যকে দেশের সামনে রেখে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠন কন্সটিটিউশনাল কন্ডাক্ট গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় এই স্বাধীন প্রতিবেদনটি লিখেছেন দেশের প্রখ্যাত বিচারপতিরা। প্রাক্তন বিচারপতি মদন লোকুর, দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এপি শাহ, দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আরএস সোধি, পাটনা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ এবং দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র সচিব জি কে পিল্লাইয়ের লেখা “আনসার্টন জাস্টিস: আ সিটিজেন কমিটি রিপোর্ট অ্যান্ড দ্য নর্থ ইস্ট দিল্লি ভায়লেন্স ২০২০” শীর্ষক রিপোর্টে নিরপেক্ষতার সঙ্গে আসল সত্য দেশের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
দিল্লি হিংসার আগে এবং পরের ঘটনাক্রমের ওপর গভীর নজর রেখে, এই প্রতিবেদনটি আমাদের সামনে বেশ কিছু উদ্বেগজনক প্রশ্ন এনেছে। প্রথমত বলা যায়, প্রতিবেদনটি এই সত্যকে তুলে ধরে যে দিল্লি হিংসা কোনও কাকতালীয় বা দুর্ঘটনা ছিল না। বিদ্বেষের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। রিপোর্ট নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় রাজনীতিবিদ, টিভি চ্যানেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্রকাশ্যে মুসলিম বিদ্বেষের প্রচার করেছিল এবং শাহিনবাগের মতো প্রতিবাদকে দেশবিরোধী বলে কলঙ্কিত করেছিল। দিল্লি নির্বাচনের সময় বিজেপি নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যও এই হিংসার পরিবেশ তৈরি করেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু বিষয়ে জানার পরেও কেন পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি? দ্বিতীয় প্রশ্নে দিল্লি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হিংসার পূর্ণ আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এবং এই বিষয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পরেও কেন দিল্লি পুলিশ দাঙ্গা থামাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? দাঙ্গা শুরু হওয়ার পরও কেন পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি? কারফিউ জারি করতে দু’দিন দেরি হল কেন? দাঙ্গার সময় দিল্লি পুলিশকে কেন অনেক জায়গায় দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে দাঁড়াতে দেখা গেল? তৃতীয় প্রশ্ন দিল্লির আম আদমি পার্টি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। হিংসায় আহতদের সময়মতো চিকিৎসার সুবিধা এবং তাৎক্ষণিক ত্রাণ প্রদানে কেন গাফিলতি ছিল? বাড়িঘর থেকে উৎখাত হওয়া মানুষের জন্য তৈরি করা ত্রাণ শিবির কেন হুট করে বন্ধ করে দেওয়া হল? কেন হিংস্রতা ও অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে লাল ফিতের বাঁধন প্রাধান্য পেয়েছে? চতুর্থ প্রশ্নটি আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। দিল্লি দাঙ্গার পরে ৭৫৮টি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এই সমস্ত এফআইআর এবং আদালতের চলমান মামলাগুলি গুরুত্ব দিয়ে পরীক্ষা করার পরে, এই প্রতিবেদনটি আমাদের বিচার ব্যবস্থার যে চিত্র উপস্থাপন করে তা খুব বেশি আশা জাগায় না। রিপোর্টে হাজির করা প্রমাণ থেকে এটা স্পষ্ট যে যেখানেই মুসলিমরা হিংসার শিকার হয়েছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দিল্লি পুলিশ এবং সরকারি প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তদন্তে শিথিলতা তৈরি হয়েছিল এবং এমন মামলা তৈরি করা হয়েছিল যা আদালতে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ এগিয়ে গিয়ে প্রমাণ তৈরি করে, মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। বিচার বিভাগও এই বিষয়ে দিল্লি পুলিশকে নিয়ে বেশ কড়া মন্তব্য করেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধীদের ষড়যন্ত্র হিসাবে দাঁড় করোনো দিল্লি দাঙ্গার মামলাটি বিশেষভাবে পরীক্ষা করে প্রতিবেদনের মতামত হল, মামলাটি ভুয়ো। উল্লেখ্য, এই মামলাটি এখনও চলছে এবং এর জন্য অনেক সমাজকর্মীকে ইউএপিএর মতো আইনের অধীনে জামিন অযোগ্য ধারায় কারাগারে রাখা হয়েছে।এই চারটি প্রশ্নের পেছনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, ১৯৮৪ সালের মতো দিল্লি সরকারের নাকের ডগায় ঘটে যাওয়া এই লজ্জাজনক হিংসার সত্যতা যদি কোনো বেসরকারি সংস্থাকে খুঁজে বের করতে হয়, তাহলে কি এদেশে আইনের শাসন রয়েছে?
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
অনুবাদ: শুভম সেনগুপ্ত
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct