গহরজান
আহমদ রাজু
গত সপ্তাহের পর...
গহরজান মেয়ের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মুখ থেকে তার কোন শব্দ বের হয় না। বয়স আর সমাজ-সামাজিকতা তাকে মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করেছে। মনে মনে তার মেয়েকে মন ভরে আশির্বাদ করে গহরজান। বলে,”কতদিন পরে তোরে দ্যাখলাম মা। ক্যামন ছিলি এতদিন? জামাই কিরাম আছে রে? আর হ্যা, আমার যে করোনা অয়চে! দূরি দাঁড়ায়ে কথা কলি ভাল করতি।”মুখ ফুটে কিছুই বলা হয় না। ঠোঁট কাঁপতে থাকে; অন্তরটা জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয় তার। ইয়াসমিন ভাইদের কাছে জিজ্ঞাসা করে মায়ের করোনা হয়েছে তারা কীভাবে জানলো। আর বাড়ি লাল ফ্লাগ টাঙালো কীসের ওপর ভিত্তি করে। তবি বলে,”মা’র বয়স হবার জন্যি টেসট্ করাতি নিতি পারিনি। তয় লক্ষণতো করোনার। তাইতো আমাগের এলাকার নেতা কটা আব্দুল থায়ে পিলাগ টাঙায়ে দিয়ে গেছে।”ছেলে- ছেলের বউয়েরা তার ধারের কাছেও ঘেঁসছে না ভয় আর ঘৃণায়। গহরজানের হৃদস্পন্দন ক্ষীণ হয়ে আসে ক্রমেই। সে অস্পষ্ট স্বরে ডাক দেয়,”ও হবি, তবি, রবি; আমি আর বাঁচপো না রে বাপ। ইয়াসমিনরে এটটু খবর দে।”ইয়াসমিন আজ সকালে এসে বিকেলেই তার শ্বশুর বাড়িতে ফিরে গেছে; যা তার মনে নেই। এ কারণে অস্পষ্ট স্বরে তার ছেলেদের উদ্দেশ্যে কথাটি বলে। কথাটি ছেলেদের কান পর্যন্ত গিয়েছে বলে মনে হয় না গহরজানের। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারিদিকে জোড়া জোড়া চোখ জ্বল জ্বল করছে। দূর থেকে ভেসে আসে শেয়াল-কুকুরের ডাক। গহরজান এখন মুক্ত। তার বহু বছরের আশা পূর্ণ হয়েছে। এখন সে শান্তিতে জীবন পরবর্তী সময় অতিবাহিত করতে পারবে ভেবে স্বস্তিতে চারিদিকে তাকায়। তাকে ঘিরে ধরে আছে অনেকগুলো শেয়াল-কুকুর জাতীয় প্রাণী। যে মানুষটা কুকুর দেখলে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠতো তার চারিপাশে কিনা এতগুলো প্রাণী! সে অনেক চেষ্টা করেও মনের ভেতরে ভয়ের আলামত তৈরী করতে পারে না। আচমকা ঘাড়ের কাছে কিসের যেন নিঃশ্বাসের উষ্ণতা পায়। ভাবে, হয়তো মৃতদেহ খেতে এসেছে; এখনি হয়তো তাকে খেয়ে শেষ করে ফেলবে। তাহলে মৃত্যুর পর এভাবেই বুঝি মৃতদেহ খেতে চলে আসে পশুর দল! পায়ে হাতে পিঁপড়ে জাতীয় কিসে যেন কামড়িয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। নিঃশ্বাস নিতে আগের মতো কষ্ট। শীতও লাগছে খুব। সাথে দখিনা হিমেল হাওয়া। মৃত্যু পরবর্তী যন্ত্রণা বুঝি এমন হয়! ঈমাম সাহেব কেন তবে সেদিন বলেছিলেন, দোজখের আযাব খুবই কঠিন! তার ভাবনা দূর থেকে বহুদূরে হারিয়ে যায়। “তবে কী আমি বেহেস্তেত মদ্যি?”বিভিন্নভাবে সে জেনেছে বেহেশতের বর্ণনা। সেই বর্ণনার সাথে বর্তমান অবস্থার খুব বেশি মিল নেই। “তালি আমি এহনে কনে আচি?”সাতপাঁচ ভেবে কোন উত্তর খুঁজে পায় না সে। বলল,”কিয়ামতের আগে হইতো এবাবে চলবেনে।”“আমি এহা ক্যান? কাউরেতো দেখতিচি নে!”নিজেকে প্রশ্ন করে। পৃথিবী থেকে শুধু যে সে একা বিদায় নিয়ে এখানে এসেছে তা নয়; হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদায় নিয়ে এখানে এসেছে- আসছে। কই তাদের কাউকেতো দেখছে না! মনের ভাবনা মনে থাকতেই একটা আলোর বহর তার দিকে আসতে দেখে মনটা শান্ত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে আলোটা আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
বলো হরি, হরি বোল বলতে বলতে আলোর বহর কাছে এসে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা গহরজানের গায়ে ধাক্কা লেগে একজন উচোট খাওয়ার জোগাড়।”কী রে বাবা, সব জাগায় তো চালাকি! শ্মশানে আসে যদি না পুড়ায় তালি লাশের কি কোন ধর্ম্ম থাকলো?”একজন বলল। একজন হ্যারিকেনটা মুখের কাছে ধরে বলল,”এই কেউ ওদিক যাস নে। মনে হয় করোনার রুগী ছিল। ছুয়ালরা পয়সা বাঁচাইচে।”একজন বলল,”মনে হয় বেশি সময় ফেলিনি। তা না হলি তো লাশেরতে গোন্দ ছুটতো।”অপেক্ষাকৃত বয়স্ক একজন বলল,”তা ঠিক, কালকে সকালে আসে দেকা যাবেনে। চল, এইডেরেতো আগে চিতায় উঠোই। যদি কাঠ বাঁচে তালি ভগবানের ইচ্ছাই ব্যবস্থা একটা হবেই।”বলো হরি, হরি বোল বলতে বলতে তারা চললো সামনের নদীর ধারে, যেখানে চিতা সাজানো আছে আগে থেকে। আর যাই হোক সকল কিছু অনুভবে আসে গহরজানের। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে চিতার আগুন। ঐ আগুনে সারা শ্মশান আলোকিত হয়ে যায়। হৃদয় জুড়ে তার হাহাকার। এটা বুঝতে পারে. ছেলেরা তাকে কবর না দিয়ে রাতে আঁধারে এই শ্মশানে ফেলে গেছে! তবে একদিক দিয়ে ভালোই করেছে বলে মনে হয় তার। অন্তত কোন ঋণ তাকে হতে হয়নি। তা না হলে ছেলেদের কাছে তার ঋণী হবার সম্ভবনা ছিল। কাফনের কাপড় কেনা, আগরবাতি, গোলাপজল, গন্ধ সাবান আরো কত কী! দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে গহরজান। এখন মনটা যে বেশ ফুরফুরে লাগছে। যাকে পোড়াচ্ছে সে তো কিছুক্ষণ পরেই ভূত হয়ে তার সাথে সঙ্গ দেবে, তার অপেক্ষায় আছি আমি। মনে মনে কথাটা আওড়িয়ে যায় গহরজান। হঠাৎ এক পশলা শীতল হাওয়ায় শরীরে কাঁপুনি লাগে। এমনিতে শীতকাল। তার ওপর এমন হিমেল হাওয়া! গালে যে কয়টা দাঁত আছে তারা একটার সাথে আর একটা লেগে যায়। সামনে চিতার আগুন নিভতে শুরু করেছে। যারা এসেছিল তারা ফিরে গেছে অনেক আগেই। বলো হরি, হরি বোল শব্দটা হঠাৎ কানের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবারো মশাল হাতে গোটা পাঁচ/ছয়জন লোক। এবার লাশের সঙ্গে কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। মনে হয় এরা সবাই টাকার বিনিময়ে লাশ পোড়াতে এসেছে। একথায় পেশাজীবী কাঠুরে। পাশ দিয়ে গেলেও গহরজানের দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। তারা তাড়াতাড়ি দুটো চিতা পরপর সাজিয়ে অগ্নিসংযোগ করে তাতে। এক আলোকচ্ছটায় মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গহরজানের। সে বুঝতে পারে মৃত্যু পরবর্তী জীবনের স্বাদ। এখানে ভয় নেই- ক্লান্তি নেই- ক্ষুধা নেই, চাওয়া-পাওয়ারও কিচ্ছু নেই। কিন্তু কিছু একটা আছে। মনে খটকা লাগে তার। উঠে বসার জন্যে আশপাশের কিছু হাতড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। পারে না। তিন ছেলেকে একবার ডাকতে চেয়েছিল। সে ডাকে না। তারা যখন কাফনের কাপড় কেনা আর মায়ের শেষ যাত্রায় সামান্য খরচের ভয়ে তাদের মৃত মা’কে কবর না দিয়ে শ্মশানে ফেলে গেছে তখন তাদের ডাকতে ইচ্ছে হয় না। তারা সবাই ভাল থাক। আর কবর দিলেই বেহেশতে যেতে পারতো তা নয়; তার কর্মফলই তাকে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। মনে মনে ভাবে গহরজান। বেশ কিছু সময় রাতজাগা কুকুরের আনাগোনা ছিল না। এখন আবার শুরু হয়েছে। পায়ের গোড়ালিতে কিসে যেন একটা কামড় বসিয়ে দেয়। চিল্লিয়ে ওঠে গহরজান। সে ক্ষীণ স্বর কাঠুরিয়াদের কানে যায়। তারা সবেমাত্র চিতার আগুণ শেষ করে বাড়ির দিকে ফিরতে পা বাড়িয়েছিল। শব্দের উৎপত্তি খুঁজতে খুঁজতে কাছে এসে দেখে একজন বৃদ্ধ মহিলা শ্মশানের খালি মাটিতে পড়ে আছে। একজন নাকের কাছে হাত দিয়ে বুঝতে পারে নিঃশ্বাস এখনও চলছে। কোন কিছু না ভেবে কিছুক্ষণ আগে যে বাঁশে ঝুলিয়ে মৃতদেহ এনেছিল সেই বাঁশে ঝুলিয়ে গহরজানকে তারা হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। গহরজান তখনও বুঝতে পারে না কি হচ্ছে! মৃত্যু পরবর্তী জীবন এমন হয় তা তার আগে জানা ছিল না। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর তাকে ঘুমের রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল। যখন চোখ মেলে তাকায় তখন সে নিজেকে নরম বিছানায় আবিষ্কার করে। পাশের সেবিকাকে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে,”তুমি কি মা দুনিয়াতে নার্স ছিলে?”সেবিকা বুঝতে পারে ব্যাপারটা কি। তাইতো বলল,”না দাদী মা, তা হবে কেন?”“তালি তুমি কি ছিলে?”“আমি মরতে যাবো কেন?”সেবিকার মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। “তালি তুমি মরে যাওনি?”কপালে চিন্তার ভাজ গহরজানের। আপনার কি মনে হয় এটা মরণ কাল?”“হ্যা তাইতো।”“আপনি বেঁচে আছেন, এখন হাসপাতালে।”“তালি...”গহরজানের কথা শেষ না হতেই সেবিকা প্রশ্ন করে,”তাহলে কী দাদী মা?”“এই যে শ্মশান, চিতা, ধুধু মাঠ, কালো রাত এত্তকিছু? আর আমি তো করোনায় মরে গিছি।”সেবিকা গহরজানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”আপনার করোনা হয়নি। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”গহরজান মনে মনে ভাবে, আসলেইতো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু ঠিক হবে না মনের ক্ষত। যে ক্ষত তার সন্তানরাই তৈরী করেছে। তবুও তারা ভাল থাক। গহরজান আবারো ঘুমের রাজ্যে। সে বিচরণ করতে চায় অচেনা জগতে। যে জগতে নেই চাওয়া- পাওয়া, দেওয়া-নেওয়া, স্বার্থ- মোহ আর করোনা ক্রান্তিকাল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct