লোমহর্ষক ঘটনা। ফোর্ট উইলিয়মের ভেতর ছোট একটি ঘর। ১৫ ফুট/১৮ ফুট। ১৪৬ জন ইংরেজকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ঘরটায় কোন জানালা নেই। দরজা বন্ধ করলে আলো আর বাতাস ঢোকার কোন জায়গা থাকে না। তাই সেই অন্ধকূপে আটকে থাকা ১২৩ জন অবিলম্বে মারা গেলেন। এ ঘটনা ১৭৫৬ সালের ২০ জুনের। কার নির্দেশে ঘটল এমন অমানুষিক কাণ্ড? কেন, বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লার। কোন দিকে না তাকিয়ে, কোন কিছু বিচার না করে এ ঘটনা শুনলে নিন্দা করতে হয় সিরাজকে। বাংলার মানুষ নিন্দে করুক সিরাজকে, এটাই চেয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্তারা। তাই হলওয়েল সাহেবকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন একটা বিবরণ। অন্ধকূপ হত্যার সেই বিবরণ হলওয়েলসাহেব দিয়েছিলেন তাঁর ‘ইণ্ডিয়া ফ্যাক্টস’ বইতে। নিহত ইংরেজদের জন্য ফোর্ট উইলিয়মের সামনে বানানো হয় এক শহিদস্তম্ভ। পরে অবশ্য সেই স্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়। হলওয়েলের সেই রঙিন গপ্পো আমাদের অনেক দেশবাসীও গিলেও ফেলেছিলেন। সখারাম গণেশ দেউস্কর তাই তাঁর ‘দেশের কথা’য় লিখেছেন, “ইংরেজ ইতিহাস লেখকরা হিন্দু ছাত্রদের হৃদয়ে মুসলমানবিদ্বেষ প্রজ্জ্বলিত রাখিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছেন। পরিতাপের বিষয় কোন কোন অদূরদর্শী হিন্দু লেখক কাব্য-নাটকাদিতে অনর্থক মুসলমান ভ্রাতাদিগের নিন্দাবাদ করিয়া ইংরেজের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিষয়ে সহায়তা করিতেছেন।”এই ‘অদূরদর্শী হিন্দু লেখক’দের মধ্যে একজন হলেন নবীনচন্দ্র সেন। তিনি লিখেছিলেন ‘পলাশির যুদ্ধ’। সেটি আখ্যানকাব্য। তারপর গিরিশ ঘোষ যখন ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটক লিখলেন, তখন সে নাটক পড়ে আপশোশ হল নবীনচন্দ্রের। গিরিশ ঘোষকে তিনি চিঠিতে লিখলেন, “বিশ বৎসর বয়েসে আমি ‘পলাশির যুদ্ধ’ লিখিয়াছিলাম, আর তুমি ষাট বৎসর বয়েসে ‘সিরাজুদ্দৌল্লা’ লিখিয়াছ। আমি বিদেশি ইতিহাসে যে ভাবে পাইয়াছি সেই ভাবে চিত্রিত করিয়াছি। কিন্তু তুমি সিরাজের নিখুঁত চিত্রটি অঙ্কিত করিয়াছ। অতএব তুমি আমার অপেক্ষা ভাগ্যবান।” একই ভুল করেছিলেন হেমলতাদেবী। তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণের সমালোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, “সিরাজুদৌল্লার রাজ্য শাসনকালে অন্ধকূপ হত্যার বিবরণ লেখিকা অসংশয়ে প্রকাশ করিয়াছেন। যদি তিনি শ্রীযুক্তবাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রের ‘সিরাজুদৌল্লা’ পাঠ করিতেন তবে এই ঘটনাকে ইতিহাসে স্থান দিতে নিশ্চয় কুণ্ঠিত হইতেন।”
অক্ষয়কুমারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছিল। অক্ষয়কুমার যখন ত্রৈমাসিক ‘ইতিহাসচিত্র’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন , তখন তাকে স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘পরের মুখে নিজেদের কথা না শুনে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধার এবার বুঝি সম্ভব হবে।’ ‘পরের মুখে নিজেদের কথা শোনার’ ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। ইংরেজদের লেখা ভারতের ইতিহাসের কথা বলছেন তিনি। যে হলওয়েলসাহেবকে বন্দি অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল সিরাজের সামনে, সিরাজ যাঁকে হত্যা করতে পারতেন অথচ করেননি, সেই বীরপুঙ্গব হলওয়েল সিরাজকে অপদস্ত করার জন্য অন্ধকূপ হত্যার গল্প ফেঁদেছিলেন।হলওয়েলের নিজের বিবরণ থেকে [Long’s Selection from the Records of India, vol,1] জানা যায় সিরাজের কলকাতায় আসার আগে দুর্গে ছিলেন ৬০ জন শ্বেতাঙ্গ মানুষ । এঁদের মধ্যে আবার গভর্নর ড্রেক , সেনাপতি মিনচিন , চার্লস ডগলাস , হেনরি ওয়েডারব্যারন, লেঃ মেপলটফট, রেভারেণ্ড ক্যাস্টন , মিস্টার ম্যাকেট, ফ্রাঙ্কল্যাণ্ড , মানিংহাম , ক্যাপ্টেন গ্র্যান্ট আক্রমণের আগে ‘য পলায়তি স জীবতি’ নীতি অনুসরণ করেছিলেন। পলাতক ১০ জন। তাহলে ৬০এর মধ্যে রইল বাকি কত? ৫০। অথচ হলওয়েল প্রচার করেছেন নিষ্ঠুর সিরাজ অন্ধকূপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন ১২৩ জন মানুষকে। ঘরটির আয়তন বিচার করে অ্যানি বেসান্ত পরিহাস করে বলেছেন জ্যামিতির প্রমাণে পাটিগণিতের সংখ্যা মিথ্যা প্রমাণিত। তার মানে এই ছোট ঘরে ১৪৬ জন মানুষকে ঢোকানো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু গল্পের গরু তো গাছে ওঠে। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সিরাজদৌল্লা সম্বন্ধে ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন ‘ভারতী’ পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে ‘সিরাজদৌল্লা’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালে। ‘ভারতী’র সেই লেখা সম্বন্ধে পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অক্ষয়কুমার লেখেন , “সিরাজদৌল্লা শীর্ষক প্রবন্ধ ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হইয়াছিল , তাহার নধ্যে দুইটি কথা সর্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হ্ইয়া গিয়াছে। সিরাজদৌল্লার অপরাধ ছিল না , প্রতিহিংসাসাধনের জন্যও পলাশির যুদ্ধ সংঘটিত হয় নাই। এই দুইটি কথা যে সর্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হইয়াছে তাহার প্রধান প্রমাণ নূতন স্মৃতিস্তম্ভ। পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যে কলঙ্কলিপি সংযুক্ত ছিল, তাহাতে এই দুটি কথা উল্লিখিত ছিল। নূতন স্মৃতিস্তন্ভে যে ফলকলিপি সংযুক্ত হইয়াছে তাহাতে এই দুটি কথা স্থানলাভ করিতে পারে নাই।“ইহা ইতিহাসের পক্ষে অল্প লাভ নয়। আরও একটি লাভের কথা এই যে, হলওয়েল পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভে যাহাদিগের অন্তকূপে নিহত হইবার কথা ক্ষোদিত করাইয়া গিয়াছিলেন , নূতন স্মৃতিস্তম্ভ রচনার সময়ে তথ্যানুসন্ধানে জানা গিয়াছে, তাহাদের কেহ কেহ দুর্গজয়ের পূর্বে বা সমসময়ে দুর্গরক্ষার্থ প্রাণত্যাগ করেন, তাহাদের পক্ষে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইবার সময় ছিল না। সুতরাং হলওয়েলের মৃতের তালিকা যে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসযোগ্য নহে, সে কথাও প্রকারান্তরে স্বীকৃত হইয়াছে। হলওয়েল ঢাকার যে হত্যা কাহিনি রচনা করিয়াছিলেন, তাহাও যে সর্বৈব মিথ্যা, সমসাময়িক ইংরেজ-দরবার তদন্ত করিয়া , সরকারি রিপোর্টে সে কথা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।”১৯১৫ সালে অক্ষয়কুমার আবার অন্ধকূপ হত্যার ব্যাপারে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ ধ্বনিত করেন। ১৯১৫ সালের ২৪ মার্চ এশিয়াটিক সোসাইটির সভায় প্রমাণ করেন অন্ধকূপহত্যার কাহিনিটি আদ্যন্ত মিথ্যা। ক্যালকাটা হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির পত্রিকায় তাঁর ভাষণটি মুদ্রিত হয় এবং জে এইচ লিটল তাঁর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন যে অন্ধকূপ হত্যার কাহিনি একটি বিশাল ধাপ্পাবাজি [gigantic hoax]. শাসক যখন ইতিহাস রচনা করেন, তখন তাঁদের কৃতিত্ব বড় করে দেখান। প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য বিকৃত করেন ইতিহাস। স্বাধীন ভারতের শাসক শ্রেনিও তার ব্যতিক্রম নয়।
দিলীপ মজুমদার....
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct