কল্লোল যুগের ব্যতিক্রমী কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের প্রথম স্পষ্ট করে দিলেন যে মৃত্যু আসলে দুই- জৈবিক মৃত্যু ও মানসিক মৃত্যু। রবীন্দ্র-চেতনায় মানসিক মৃত্যুর ব্যাপারটি ততটা স্পষ্ট ছিল না। লিখেছেন বিশিষ্ট লেখক রমজান আলি..
আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।’- কল্লোল যুগের ব্যতিক্রমী কবি জীবনানন্দ দাশ আমাদের প্রথম স্পষ্ট করে দিলেন যে মৃত্যু আসলে দুই- জৈবিক মৃত্যু ও মানসিক মৃত্যু। রবীন্দ্র-চেতনায় মানসিক মৃত্যুর ব্যাপারটি ততটা স্পষ্ট ছিল না। জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন- যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে’ (ধূসর পাণ্ডুলিপি)। ঔপনিষদিক ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ তখন বলেন- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ কিংবা ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ কাব্য জীবনের প্রথম দিকেই দুই কবির মৃত্যু সম্পর্কিত এই উচ্চারণের সুর ভিন্ন হলেও প্রসঙ্গ একই, মৃত্যু। রবীন্দ্রনাথ আত্মচৈতন্যের মধ্য দিয়ে ঔপনিষদিক উপলব্ধিতে মৃত্যুকে আপন করে নিতে চেয়েছেন। কয়েকজন আত্মীয়ের বিয়ােগ কবিকে চিরন্তন ভাবে প্রভাবিত করেছিল। মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু ও কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু এর মধ্যে অন্যতম! মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু কবির বাল্যজীবনে ঘটায় এরং তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী না হলেও যৌবনে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কবির সমস্ত জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। কবি তা স্বীকারও করেছেন-“... আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে।”মৃত্যু সম্বন্ধে কবির বােধ ও চেতনা একটা জায়গায় এসেছিল। মাতার মৃত্যুর ফাঁক পূরণ করেছিল কাদম্বরী দেবী। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তরুণ যৌবনে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু কবির জগৎ ও জীবনকে স্তব্ধ করে দিলে তিনি জগৎকে আরও সুন্দরভাবে দেখতে পেয়েছিলেন এবং মহাজীবনের চলমানতা অনুভব করেছিলেন। কবির ভাষায় “জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে-দূরত্বের প্রয়ােজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল।”(জীবনস্মৃতি: মৃত্যুশোক) মৃত্যু জনিত আঘাত ও তার মহতী অনুভূতি কবিকে বিষাদগ্রস্থ করে এবং তার যন্ত্রণা থেকেই তিনি সৃষ্ঠির খেলায় মেতে উঠেন।
নৈবেদ্য’(১৯০২) কাব্য থেকেই একটা মৃত্যুচেতনা ক্রিয়াশীল ছিল। স্মরণ’(১৯০৩)”কাব্যটিতে মৃত্যুভাবনা জাত। একবছর আগে কবি পত্মী মৃণালিনীদেবীর মৃত্যু হয়েছে। তবে কাদম্বরীর মৃত্যুর মতো এই মৃত্যুতে কবি ততটা বিচলিত না হলেও পত্মীকে স্মরণ করেই একটি কাব্য লিখলেন। তিনি কিছুটা আক্ষেপ করেই বলেছেন- সে যখন বেঁচে ছিল গো, তখন যা দিয়েছে বারবার তার প্রতিদান দিব যে এখন সে সময় নাহি আর। (২ সংখ্যক) তারপরই তিনি ভগবৎ সত্তার কাছে তাকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত থাকতে চান- রজনী তাহার হয়েছে প্রভাত, তুমি তারে আজি লয়েছ হে নাথ- তােমারি চরণে দিলাম সঁপিয়া। কৃতজ্ঞ উপহার। (২ সংখ্যক) উল্লেখ্য যে ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে’ গানটি মৃণালিনী দেবীকে স্মরণ করেই লিখেছিলেন। তবে এ গান শুধু কি মৃণালিনী দেবীর জন্যই? নাকি সঙ্গে কাদম্বরীও আছেন? গীতাঞ্জলি কাব্যে মূলত ঈশ্বরকে ‘পরানসখা’ রূপে দেখা হলেও বেশ কয়েকটি কবিতায় কবির মৃত্যুচেতনার মহতী অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। ৫৯ সংখ্যক কবিতার শুরুতে কবি বলছেন-‘এবার নীরব করে দাও হে তােমার ...’। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে কবি নিজেকে নীরব করে দিতে বলছেন কেন? তিনি কি মৃত্যু কামনা করছেন? না কি বাক্ বিস্তার বা মুখর কবি স্বভাব বন্ধ রেখে শুধু অনুভূতির রাজ্যে নীরবে অবগাহন করে বাকি জীবনটা কাটাতে চাইছেন? যদি তাই হয় তা হলে আত্ম-যন্ত্রণাটাই বা কি? নিশীথরাতে তিনি তার বাঁশি শুনতে পান। সেই তানে গ্ৰহশশী আবাক হয়। তারপরই কবির আত্ম সমর্পণের ইচ্ছাটা প্রবল হয়। কবি জানিয়ে দেন যে জীবনে-মরণে ছড়িয়ে থাকা সবকিছু গানের টানে বাঁশিবাদকের চরণে মিশে যাক। ব্লাকহােলের একটা টান কবি অনুভব করছেন। ব্যক্তিভাবনা কবিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তােমার’ শব্দটি দ্বিসত্ত্বা থরথর করে কাঁপতে থাকে। সৃষ্টির ভাব মুক্ত হলে কবি একলা অকূল অন্ধকারে বসে তার গান শুনতে পাবেন। মনে রাখতে হবে গভীর রাত্রিই পারে মানুষকে একাকীত্ব দিতে।
মৃত্যুর এই আলাে-আঁধারী খেলা থেকে এবার সরাসরি উচ্চারণ করলেন- ‘মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তােমার দুয়ারে’ (১১৪ সংখ্যক)। মরণ দুয়ারে এলে তিনি দেহ অন্তস্থিত প্রাণকে তার হাতে তুলে দেবেন। শূন্য হাতে তাকে বিদায় দেবেন না। সুখ দুঃখের আলাে-ছায়ায় বিভিন্ন ঋতুতে জীবনের যে স্বাদ পেয়েছেন, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন। তাকে তিনি ডালা সাজিয়ে মরণের হাতে তুলে দেবেন। জন্ম ও মৃত্যুর এই জৈবিক নিয়মকে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক করে দেখেছিলেন। রােগশয্যা’ (১৯৪০) থেকে আরােগ্য’ (১৯৪১) পর্যন্ত কবি মৃত্যুর হাতছানি বেশ ভালােভাবেই অনুভব করেছেন। তিনি মৃত্যুকে জীবনের পূর্ণরূপ হিসাবে দেখেছিলেন। রােগশয্যায় বিলগ্ন অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুঞ্জয় কবি। জীবনের পাশাপাশি মৃত্যুকেও তিনি। পরিপূর্ণভাবে উপভােগ করতে চেয়েছেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের কালিম্পং-এ কবি ‘কোমা’ রােগে আক্রান্ত হন। সুস্থ হয়ে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে বসে রােগশয্যার কবিতাগুলি লিখলেন। রােগশয্যার ২৫ সংখ্যক কবিতায় লিখলেন- জীবনের দুঃখে শােকে তাপে/ কবির একটি বাণী চিত্তে মাের দিনে দিনে হয়েছে উজ্জ্বল/আনন্দ অমৃতরূপে বিশ্বের প্রকাশ।। তাই এই পৃথিবীতে জন্ম সার্থক। এর পরে পরেই লিখলেন আরােগ্য। উপনিষদের বাণীর মতােই তিনি উচ্চারণ করলেন- এ দ্যুলােক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি। /অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি/এই মহামন্ত্রখানি। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন আশি বছর তিন মাস। কবির আশিতম জন্মদিনে প্রকাশিত ‘জন্মদিনে’ কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ। জন্মদিনেই শেষ যাত্রার সম্ভাবনায় কবির চেতনা সচকিত। এই পটভূমিকায় তিনি জন্মদিনের কবিতাগুলি রচনা করেছেন। বেশ কয়েকটি কবিতা ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে গুরুতর ব্যাধির আগে লেখা। জন্মদিনে কাব্যের বেশ কয়েকটি কবিতায় কবির এই মনােভাব প্রতিফলিত হয়েছে। জন্ম-মৃত্যুর মিলন মােহনায় দাঁড়িয়ে কবি যে কাব্যরচনা করেছেন তার নাম দিয়েছেন জন্মদিনে। জন্মদিন পালনের একটা আবেগ-উচ্ছাস এবং আনন্দ মেদুরতা, আনন্দ-বিহুলতা থাকলেও এই কাব্যের অধিকাংশ কবিতার অবকাশ মৃত্যুর স্থির পদধ্বনি শােনা যায় জন্মদিনেই কবি মৃত্যুর দুঃসংবাদ অনুভব করেছিলেন- ‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ ; আপন আগুনে শােক দগ্ধ কবি দিল আপনারে, উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে।”(৮ সংখ্যক) জীবনে মৃত্যু যেন সূর্যের অস্ত যাওয়ার মতােই অন্ধকার ঘনিয়ে আনা ঘটনা। মৃত্যুর এই বার্তাই কবিকে জীবনের পশ্চিম সীমায় পৌছে দিয়েছে। মৃত্যুকে জীবনের পূর্ণরূপ হিসাবে দেখেছেন বলেই আলােকে তিনি অনুভব করেছেন-”যাহে জন্ম মৃত্যু এক হয়ে আছে। মৃত্যুকে
বরণ করে নিলেই জীবনের অখণ্ড উজ্জ্বল অমরতালাভ করা যায়। মৃত্যুর মহা আবির্ভাবের জন্যই কবি প্রতীক্ষা করে আছেন। ৫-সংখ্যক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বয়সে জন্মদিন পালন করতে গিয়ে অতীত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা স্মরণ করেছেন। পৃথিবীর বিচিত্র রহস্য ভাণ্ডারের সঙ্গে কবি পরিচিত হয়েছেন। আজ তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষায়- “সাবিত্রী পৃথিবী এই, আর এ মর্তনকেতন, আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলােকে সমীরণে ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে কি গুঢ় সঙ্কল্প বহি করিতেছে সূর্য প্রদক্ষিণ- সে রহস্য সূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশিবর্ষ আগে, চলে যাব কয় বর্ষ পরে।”(৫-সংখ্যক) বাঁচার প্রবল ইচ্ছা এবং আরাে কয়েক বর্ষ ধরে পৃথিবীকে চিনে নেওয়ার আকাঙক্ষায় কবি একটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন। তখনও জানতেন না যে কয়েক বর্ষ নয় মাত্র তিন মাস পরেই তাকে এই ‘সাবিত্রী পৃথিবী ছেড়ে কবিকে চলে যেতে হবে। নিজের জীবনের অবসানের এই কল্পনাটি সুন্দর। প্রকৃতির সৃষ্টি সম্পদ কখনই অমর ও অমৃত নয়। প্রকৃতির প্রতিটি সঞ্জীব বস্তুই মরণশীল। কিন্তু তা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলেই তাতে। বিকৃতি নেই তাই- “ফুলদানি হতে একে একে আয়ুক্ষীণ গােলাপের পাপড়ি পড়িল ঝরে ঝরে। ফুলের জগতে মৃত্যুর বিকৃতি নাহি দেখি।”(২৬- সংখ্যক) সৌন্দর্যময় গােলাপেরও মৃত্যু আছে। ফুলদানিতে থাকলেও সে শুকিয়ে ঝরে পড়ে অর্থাৎ সুন্দর সমুজ্জ্বল গৌরবেরও একদিন অবসান ঘটে। এই সূত্রেই কবি চেয়েছেন, মৃত্যু মুহূর্তেকবিকে যেন মৃত্যু বিকৃতি গ্রাস না করে। জীবনের পূর্ণ প্রাপ্তিতে অসুন্দরের মুহূর্তে রচিত হােক কবি সেটা চাননি। তাই তিনি বলেছেন- “জন্মদিনে মৃত্যুদিনে দোহে যবে করে মুখােমুখি দেখি যেন সে মিলনে পূর্বাচলে অস্তাচলে। অবসন্ন দিবসের দৃষ্টি বিনিময়- সমুজ্জ্বল গৌরবের প্রণত সুন্দর অবসান।”(২৬- সংখ্যক) জন্মদিনে তিনি একটা দূরত্ব অনুভব করছেন। ১ সংখ্যক কবিতায় বলেছেন-”আজি এই জন্মদিনে / দূরত্বের অনূভব অন্তরে নিবিড় হয়ে এল।”সবার মধ্যে থেকেও কবি বুঝতে পারছেন জীবন ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মনের দিক থেকে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করছেন। তাই স্বীকার করছেন-”আমার দূরত্ব আমি দেখিলাম তেমনি দুর্গমে-/ অলক্ষ্য পথের যাত্রী, অজানা তাহার পরিণাম।”পথিক হিসাবেই তার এগিয়ে চলা- এ চলায় সাথী নেই। আসলে একটা মহাদূরত্ব কবিকে একাকী করে তুলছে। মৃত্যুকে অমৃত করার যে আকাঙক্ষা কবির মানসিকতায় আগে থেকেই জেগে উঠেছিল, তাকে জীবনের শেষ সময়েও সমানভাবে বজায় রাখতে চেয়েছেন। জীবন কখনই কবিকে বঞ্চনা করেনি তাই কবিও জীবনকে বঞ্চনা করতে চায়নি। কারণ তিনি পৃথিবীর কবি’ যেখানে যত ধ্বনি ওঠে তা কবির বাঁশীর সুরে নূতন করে জেগে উঠবে। তাই মৃত্যুকে কবি শূন্য হাতে বরণ করতে চান নি। কবির বিশ্বাস প্রতিটি জন্মদিন যেমন নানা রূপে মানুষকে সৃষ্টি করে তেমনি প্রতিটি জন্মদিন মানুষকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই জন্মদিনের পথ বেয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়াই হল জীবন রহস্যের মূল কথা। তাই মৃত্যু ভয়ের নয়, মৃত্যু সতত সুন্দর। মৃত্যু একটা দূরত্ব রচনা করে। মাত্র, তা শেষপর্যন্ত জীবনের অঙ্গ হিসাবে থেকে যায়। চিরকালই রবীন্দ্রনাথ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে বরাবর কৌতূহলী ছিলেন এবং তিনি এক সময় মানব নিকেতনে এসে পৌঁছে উচ্চারণ করলেন- “মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে। মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আবার মরতে না চাওয়ার কথা কেন বলছেন? অমর হয়ে থাকার কি একটা প্রবল ইচ্ছা তার মধ্যে কাজ করেছিল? প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ের গােপন গভীরতম প্রদেশে কি এমন একটা ভাবনাই কাজ করে ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct