জাইদুল হক, কলকাতা: সামনে পঞ্চয়েত নির্বাচন। তার আগে খুব সাবধানে পদেক্ষপ করতে চায় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি উপনির্বাচনে গতবারের জেতা আসন হাতছাড়া হওয়ার পরে কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয় তৃণমূল। ইতিমধ্যে হারের কারণ খুঁজতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় তৃণমূল সুপ্রিমোর সন্দেহ দানা বেঁধেছিল, হয়তো এবার সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। তাই সাগরদিঘিতে হার। যদিও মমতার গড়ে দেওয়া তদন্ত কমিটি কলকাতায় বসে মিটিং করে তদন্ত শুরু করে দিলেও ময়দানে নেমে এখনও সেভাবে খতিয়ে দেখার কাজ শুরু হয়নি বলে মুর্শিদাবাদ তৃণমূল সূত্রের খবর। কিন্তু তার আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার সন্দেহে করা আর গোপন করেননি। শুক্রবার কালীঘাটে মমতা স্পষ্ট করে অভিযোগ করেছেন, এই হারের মূলে মুর্শিদাবাদের দুই তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমান ও আবু তাহের খানের বিরুদ্ধে। আর সাগরদিঘিতে তৃণমূলের হারের জন্য যেভাবে এই দুই সাংসদের দিকে আঙুল তুলেছেন তাতে তা রাজনেতিক মহলে অবাক সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। কারণ, মমতার অভিযোগ তার দলের এই দুই সাংসদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। একদিন, কংগ্রেস নেতাদের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা শোনা যাচ্ছিল, এবার খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো আদতে স্বীকার করে নিলেন তার দলের নেতারা এখন তলে তলে কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তবে, মমতার কথায় এ কথা স্পষ্ট, তিনি যে দুই নেতার উপর ভর করেছিলেন সাগরদিঘির উপনির্বাচনে সফল হওয়ার জন্য তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। তাই তিনি সংগঠনকে যে তারা ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করতে পারেননি সে কথাই ঠারেঠোরে বোঝাতে চেয়েছেন মমতা। তাই মমতা মানতে চান না, সংখ্যালঘু ভোটে ধসের কারণে সাগরদিঘির উপনির্বাচনে হার। এ নিয়ে সঙ্গত কারণেই মমতা প্রশ্ন তুলেছেন, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় যদি হিন্দু প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যালঘুরা প্রত্যাখ্যান করে থাকেন, তাহলে সুব্রত সাহা তো হিন্দু প্রার্থী ছিলেন, তাহলে তিনি কীভাবে জিতেছিলেন?
রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন মহল এবং সংবাদপত্র জগৎ সাগরদিঘির হারের কারণ সংখ্যালঘু ভোটে ধস বললে মমতা তা অস্বীকার করেছেন শুক্রবার। সত্যিই কি সংখ্যালঘুরা তৃণমূল থেকে বিমুখ হয়েছেন, না মুখ্যমন্ত্রীর আশঙ্কাই ঠিক— দলীয় সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই তৃণমূলের ভরাডুবি?
এ নিয়ে ‘আপনজন’ সাগরদিঘি বিধানসভা নির্বাচন ও এবারের উপরনির্বাচনের বুথভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করেছে। সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় তার কী প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে বিশেষ অন্তর্তদন্ত করেছে।
সাগরদিঘি উপনির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হয় তখন রাজ্যের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি বিষয় হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার প্রভাব ভোট বাক্সে পড়া অবাক হওয়ার নয়। আরও বেশ কযেকটি বিষয় সাগরদিঘির মানুষদের মনে সরকার বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত, মুর্শিদাবাদ জেলা ভাগের নামকরণ নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, মুর্শিদাবাদ জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হবে। সেগুলি হবে জঙ্গিপুর, কান্দি ও বহরমপুর। আর তাতে মুর্শিদাবাদজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল। তাদের অভিযোগ ছিল, এভাবে মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভাগ করা হলে একদা যে নবাবদের রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ সেই নামটাই স্মৃতির অতলে চলে যাবে। আর মেদিনীপুর জেলাকে পূর্ব ও পশ্চিম, ২৪ পরগনাকে উত্তর ও দক্ষিণ করে জেলার নাম সংপৃক্ত করা হলেও মুর্শিদাবাদের নাম জেলা ভাগের সঙ্গে থাকবে না কেন সেই প্রশ্ন তোলা হয়। সেই অসন্তোষের প্রভাব পড়তেও পারে। অন্যদিকে, সাগরদিঘিতে হিন্দু প্রার্থী হলেও মুসলিমদের মধ্যে তা নিয়ে অতীতে কোনও সম্প্রদায়গত মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু এবার দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় হেরে যাওয়ায় সেই প্রশ্ন উঠছে। তবে, স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, বায়রন বিশ্বাস মুসলিম প্রার্থী বলেই সংখ্যালঘুরা বেশি ভোট দিয়েছেন এমনটা নয়। বরং, সাগরদিঘির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মুসলিমদের সিংহভাগ মানুষ বিড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকায় বিড়ি শিল্পপতি বায়রন বিশ্বাসের প্রতি বিশেষ আবেগ কাজ করেছে।
তবে, ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী যেহেতু সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রটিতে ৬৪.৬৭ শতাংশ মুসলিমের বাস তাই সঙ্গত কারণেই মুসলিমদের ভোটের উপরই প্রার্থীদের জেতা নির্ভর করে। কিন্তু সুব্রত সাহা বারে বারে জিতে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন সাগরদিঘিতে সাম্প্রদাযিক মেরুকরণে ভোট হয় না। সেটাই হয়তো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে চেয়েছেন। আর তার জন্য, সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই তৃণমূলের হারের পিছনে দায়ী করছেন।
অবশ্য, সংবাদমাধ্যম থেকে বিরোধী দল প্রায় সবাই বলছে সাগরদিঘিতে মুসলিম ভোটে ধস। তৃণমূলের ভোট কংগ্রেসের ভোট বাক্সে পড়াটাই তৃণমূলের হারে প্রধান কারণ। এ নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন ও বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে, সাগরদিঘিতে হারের মূল কারণ ঠিক কি।
এ প্রসেঙ্গে বলে রাখা ভাল ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে যে ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট সদস্য সংখ্যা ২০০। এর মধ্যে তৃণমূলের সদস্য সংখ্যা ১৩১, কংগ্রেসের ৪৩, বিজেপির ১৬, সিপিএমের ১২ ও অন্যান্য ৫। কিন্তু এই ২০০ জন পঞ্চায়েত সদস্যের মধ্যে মুসলিম সংখ্যা ১১৪, যা প্রায় ৬৫.৫ শতাংশ। আর হিন্দু সদস্য ৮৬, যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। পঞ্চায়েত সমিতিতেও তৃণমূলের একচ্ছত্র প্রভাব ছিল। পঞ্চায়েত সমিতির ৩৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূল একাই পায় ২৮টি যা পায় ৮৪.৮৪ শতাংশ, কংগ্রেস ৪ যা প্রায় ১২.১২ শতাংশ, আর বিজেপি একটি। পঞ্চায়েত সমিতিতে মুসলিম সদস্য ১৯, যা প্রায় ৫৭.৫৭ শতাংশ ও হিন্দু সদস্য ১৪ যা প্রায় ৪২.৪২ শতাংশ। অপরদিকে, জেলা পরিষদে মাত্র তিন জন সদস্য। তাার সবাই তৃণমূলের। আর এই তিনজনের মধ্যে দুজন হিন্দু ও একজন হিন্দু। সুতরাং, দেখাই যাচ্ছে সাগরদিঘিতে বরাবরই মুসলিমদের সংখ্যানুপাতের তুলনায় হিন্দুদের সদস্য সংখ্যা বেশি। তাই মুসলিমদের একটা বড় অংশ বরাবরই হিন্দু সম্প্রদায় সমর্থন করে আসছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।কিন্তু সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই শাসক দল তৃণমূলের তরফে অভিযোগ তোলা হয়, বাম কংগ্রেস ও বিজেপি একতাবদ্ধ হওয়ায় তৃণমূলকে হারতে হয়। তাদের সেই অভিযোগ তোলার প্রধান কারণ হল, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সুব্রত সাহা জিতলেও দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। কিন্তু, বিধানসভার উপনির্বাচনে বিজেপি তৃতীয় স্থানে চলে আসে। তাই বিজেপির ভোট কংগ্রেসের বাক্সে পড়ার ধারণা করা অমূলক নয়। যদিও পঞ্চায়ত নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিজেপি নয়, কংগ্রেসই সাগরদিঘিতে দ্বিতীয় শক্তি। কিন্তু উপনির্বাচনে কংগ্রেসের বিপুল ভোটে জেতার পিছনে জেতার রহস্য উদঘাটনে নানা মুনির নানা মত। এ ব্যাপারে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন ও উপনির্বাচনের বুথ ভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এ ব্যাপারে একটা বিশেষ ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি যেখানে ৮৮টি বুথে এগিয়ে ছিল সেখানে উপনির্বাচনে একটি বুথেও জয়ী হতে পারেনি। অপরদিকে বিধানসভা নির্বাচনে যেখানে কংগ্রেস মাত্র তিনটে বুথে এগিয়ে ছিল। বাকি সব বুথে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। কিন্তু এবারের বিধানসভা উপনির্বাচনের বুথ ভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি গতবারের তুলনায় অর্ধেক বুথেও এগিয়ে যেতে পারেনি। তৃণমূলও বহু ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের এক নং বুথে বিজেপি যেখানে ৩৬৯, তৃণমূল (সুব্রত সাহা) ১৭৪ ও কংগ্রেস ৩৬টি ভোট পেয়েছিল, সেকানে উপনির্বাচনে ওই বুথে বিজেপি প্রার্থ দিলীপ সাহা পেয়েছেন মাত্র ১১৬টি, তৃণমূলের দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন ৩০৯টি ও কংগ্রেসের বায়রন বিশ্বাস পেয়েছেন ১১২টি ভোট। অপরদিকে বিধানসভা নির্বাচনে ৯৬ নং বুথে বিজেপি ১৩৮ পেলেও তৃণমূল পেয়েছিল ৪২৬টি ভোট। যার কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬০টি। কিন্তু উপনির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে ৮২টি ভোট, তৃণমূল ১৯৪টি ও কংগ্রেস পেয়েছে ৩৬৭টি ভোট। এক্ষেত্রে তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের ভোটই কেটেছেন বায়রন। সুতরাং, সাগরদিঘির মানুষ সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোট না দিলেও শাসক দলের প্রতি ক্ষোভের কারণে ও বিজেপির প্রতি রুষ্টর কারণে যে কংগ্রেসকে সমর্থন করাটাকে বেছে নিয়েছেন সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct