২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে হার মেনে নেয় তাহলে কেবল রাশিয়ান ফেডারেশনই নয় বরং রুশ জাতিই ভেঙে পড়তে পারে। তখন মস্কো এবং পশ্চিম উভয়পক্ষের ভাষ্যকাররাও ধারণা করেছিলেন যে, পুতিন নিজের কথা বলার পরিবর্তে একটি প্রচারণার অনুশীলনই আসলে করছিলেন। তারা মনে করেন না যে, ইউক্রেনে হেরে গেলেও রাশিয়া ভেঙে পড়বে এবং পুতিনও সেইভাবে চিন্তা করেন। রাশিয়া যদি সত্যিই হেরে যায় তার পরিণাম নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
রাশিয়া ও রুশ জাতির ভেঙে পড়া সম্পর্কে পুতিনের ভয় এইভাবে পশ্চিমের প্রতি তার ঘৃণার অচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।এর ফলে, পুতিন এই আশঙ্কাও করছেন যে, একটি কর্তৃত্ববাদী শক্তির সমর্থন ছাড়া তার রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যিক পরিচয় সহজেই আঞ্চলিক পরিচয়ে বিভক্ত হবে। আর তারপর ‘অভিশপ্ত পশ্চিম’ অংশে অংশে রাশিয়াকে নিজের মধ্যে শুষে নেবে’ (Kasparov.ru, মার্চ ৬, ২০২৩)। রাশিয়ার ভেঙে যাওয়ার ভয়ের যে কথা পুতিন বলেছিলেন তা জনগণকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে বলা কোনো কিছু নয়। আসলে এটি পুতিনের নিজের মধ্যকার একটি প্রকৃত এবং গভীর উদ্বেগ। আর এখানে একটি সভ্যতা হিসাবে পশ্চিমের প্রতি তার ঘৃণা সৃষ্টি করে যে পশ্চিমারা রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরের অধিকার প্রত্যাখ্যান করে। পুতিনের পশ্চিমের প্রতি শত্রুতা এবং গভীরভাবে আন্তঃসম্পর্কিত বিচ্ছিন্নতার ভয় স্কোবভ একা দেখেননি। তাতারস্তানের বিজনেস অনলাইন পোর্টালের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ভ্লাদিমির মারচেনকো বলেছেন যে, এই বিষয়টি যেভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে পুতিনের উপলব্ধি ইভান ইলিনের প্রভাব থেকে এসেছে, যিনি ক্রেমলিন প্রধানের প্রিয় দার্শনিক হিসাবে চিহ্নিত। কাজান বিশ্লেষকের মতে, পুতিন ইলিনের প্রশংসা করার আসল কারণ, ফ্যাসিবাদের প্রতি ইলিনের প্রতিশ্রুতি নয়। বরং, এটি রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে তাদের ভাগ করা আবেশ এবং এটি প্রতিরোধ করার জন্য যা কিছু করা দরকার তা করার জন্য তাদের সাধারণ প্রতিশ্রুতি (Kasparov.ru, অক্টোবর ২, ২০২২)। স্কোবভের মতো মার্চেঙ্কোর জন্য পুতিনের কর্তৃত্ববাদ, তাই প্রাথমিক নয় বরং এই ভয়ের প্রতিফলন, যা উভয়কে অন্য রাশিয়ান চিন্তাবিদদের থেকে আলাদা করে যারা ফ্যাসিবাদের সাথে ফ্লার্ট করেছে। উপরন্তু, এতে এই ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়, কেন পুতিন রাশিয়ায় বিভক্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এমনকি ভেঙে পড়া রোধ করার জন্য শক্তি ব্যবহার করতে দ্বিধা করছেন না। আরেক রাশিয়ান বিশ্লেষক ভ্লাদিমির পাস্তুখভ পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, এমনটি ইতিহাসে এর আগে কখনো হয়নি। সারা বিশ্বে এবং সেই সাথে রাশিয়াতেও এত বেশি মানুষ এই সম্ভাবনার প্রতি মনোযোগী হয়েছে যে, রাশিয়া ভেঙে যেতে পারে। এর আগের বছরগুলোর তুলনায় এটি তীব্রভাবে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। ১৯১৭ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যখন হয় তখন খুব কমই আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল (Polit.ru,, ৩ জুন, ২০২২)। এখন রাশিয়ার অস্তিত্বের ভয় পুতিনের নীতিগুলোকে চালিত করছে। এ কারণে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে পুতিনের কথাগুলোকে অনেক বেশি গুরুত্বসহকারে নেয়া উচিত বলে মনে হয়। একসময় কিছু পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, যুদ্ধের পরিণতিতে এক বা দুই বছরের মধ্যে রাশিয়ার পতন হবে। রাশিয়া এবং ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো টিমোথি অ্যাশ বলেছেন যে, সংস্কারমূলক শক্তির উদ্ভবের সাথে ইতিবাচক পরিবর্তনের সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও, রাশিয়ান ফেডারেশনের অনেকগুলো নতুন রাজ্যে বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যরা রাশিয়ার যেকোনো আসন্ন শাসনের পতন সম্পর্কে কম আত্মবিশ্বাসী। রাশিয়া এবং ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সহযোগী ফেলো ড. জোয়ানা সজোস্টেক বলেছেন, রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ প্রতিবাদ দমনে পারদর্শী এবং দমন-পীড়নের ব্যবস্থা বাড়িয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, গণবিক্ষোভ সাধারণভাবে শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেও বিভাজন থাকলেই একটি আবদ্ধ কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্য একটি প্রকৃত হুমকি সৃষ্টি করে। (Chathamhouse.org/2023/02/seven-ways-russias-war-ukraine-has-changed-world, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)।
রাশিয়ার জনমতের যে উল্লেখ লেখার শুরুতে রয়েছে তাতে স্পষ্ট যে, জাতিগতভাবে দেশটির ভেঙে পড়ার জোরালো আশঙ্কা নেতৃত্ব ও জনগণ উভয় পর্যায়েই রয়েছে। চ্যাথাম হাউজের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পশ্চিমের মধ্যে তেমন আকাঙ্ক্ষা যে রয়েছে তা নানা সময় প্রকাশও পেয়েছে। ফলে পুতিন সহজেই যুদ্ধ বন্ধ করবেন এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। প্রশ্ন হলো, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে? মধ্যপ্রাচ্যের দুই বিবদমান শক্তি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের অবসান ঘটানোর ব্যাপারে বেইজিংয়ের সাফল্য দেশটির নেতা শি জিনপিংকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করতে উৎসাহিত করতে পারে। তেমন ইঙ্গিত এর মধ্যে তিনি দিয়েছেন। এ কথা ঠিক যে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ থেকে স্বল্পমেয়াদে সবচেয়ে লাভবান রাষ্ট্রটির নাম চীন। কিন্তু এই লাভ মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিও নিয়ে আসতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয় এড়ানোর জন্য মস্কোর জন্য চীনা সামরিক সহায়তা প্রয়োজন অনেক বেশিভাবে অনুভব করছে ক্রেমলিন। আর এই সামরিক সহায়তার অর্থ দাঁড়াবে, চীনের পশ্চিমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া। রুশ নিষেধাজ্ঞার মতো এই ধরনের নিষেধাজ্ঞায় চীনের পাশাপাশি পশ্চিমের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়বে। কিন্তু এর পরও ভিন্ন কোন রাস্তা থাকবে না আমেরিকা ও তার মিত্রদের জন্য। বেইজিংয়ের জন্য বড় বিপদ হবে, এতে তার উত্থান পরিকল্পনায় বড় আকারের ব্যত্যয় সৃষ্টি হবে, যেটি কোনোভাবে সময় আসার আগে কামনা করবে না চীন। এ কারণে বেইজিং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। প্রশ্ন হল, কোন শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি হতে পারে? বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো পক্ষের এককভাবে শর্ত পূরণের মতো যুদ্ধ পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। এই সময়ে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি হতে হলে তা হবে দু’পক্ষের মধ্যবর্তী একটি অবস্থান নেয়ার মধ্য দিয়ে। সেটি কি হবে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ চিন এবং রাশিয়া-ইউক্রেনকে সম্মত হতে হবে যার মধ্যে ইউক্রেনের ভূমি ছেড়ে দেয়া, দেশটির ন্যাটোভুক্ত না হওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ও স্থান পেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সহজ কোনও সমীকরণ কোনও পক্ষের সামনে দৃশ্যমান নেই। (সমাপ্ত)...
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct