আপনজন ডেস্ক: বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার মননশীল ও গবেষণামূলক সংস্থা আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘উজ্জীবন ২০২৩’ খুবই জাঁকজমকভাবে অনুষ্ঠিত হল রবিবার। এদিন কলকাতার পার্কসার্কাসের ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাকক্ষে আলিয়া সংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত এই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে নানা অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনটি বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদকে দেওয়া হয় শহীদুল্লাহ পুরস্কার, সাহিত্যিক সৈয়দ রেজাউল করিমকে দেওয়া হয় মশাররফ পুরস্কার আর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুমিতা দাসকে দেওয়া হয় রোকেয়া পুরস্কার। এদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে অনুষ্ঠানের সূচনা হয় সোমঋতা মল্লিকের পরিচালনায় ছায়ানট কলকাতার নজরুল সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। এছাড়া আবৃত্তি ও কবিতা পাঠও হয়। সেই সঙ্গে আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের সাহিত্য সাময়িকী উজ্জীবন’-এর বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করা হয়। এই বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ হাসান ইমরান, দৈনিক আপনজন পত্রিকার সম্পাদক জাইদুল হক, সাপ্তাহিক নতুন গতির সম্পাদক এমদাদুলর হক নূর ও উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদের হাত ধরে। মূল অনুষ্ঠানটি ছিল দ্বিতীয় পর্বে। শিক্ষাবিদ ড. আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে দ্বিতীয় পর্বে পুরস্কার প্রাপকরা তাদের বক্তব্যে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে নানা মূল্যবান কথা তুলে ধরেন। ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, বাংলা ভাষা চর্চায় প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল কোনও বাঙালির হাত ধরে নয়। ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি প্রথম বাঙলা ভাষার বিকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি সেই উদ্যোগ না নিলে আজ বাঙলা ভাষা মৃত ভাষা হিসেবেই পরিগণিত হয়ে পড়ত। বাংলা ভাষাকে জীবিত করার ক্ষেত্রে তাই বখতিয়ার খিলজির অবদানের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে বলেন, অনেকে আরবি ভাষা শিক্ষাকে সম্প্রদায় ভিত্তিক ভাষা হিসেবে দেখে থাকেন। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে আরবি ভাষা চর্চার অনীহা সম্পর্কে আত্মসমালোচনা করে বলেন, আরবি ভাষা শিখে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন কেরলে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন। অথচ, মুসলিমদের মধ্যে সেই প্রবণতার অভাব। একসময় কাজী আবদুল ওদুদ ও আবু সায়ীদ আইয়ুবের বিশেষ চর্চা আলোকিত করলেও তা পরে আর সেভাবেই চর্চিত নয়। এছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তীতে চতুরঙ্গ সম্পাদক আবদুর রাউফের বিশেষ অবদানের কথাও তুলে ধরেন।
রোকেয়া পুরস্কার প্রাপ্ত সুমিতা দাস তার বক্তৃতায় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখার অনুপ্রেরণার কথা তুলে ধরেন। রোকেয়ার লেখা তুলে ধরে তিনি বলেন, শতবর্ষ আগে বেগম রোকেয়া মহিলাদেরকে পুরুষদের মতো সম দক্ষতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিলেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলে তার সেই অদম্য মনোভাব মহিলাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম পাথেয় করে তিনি মন্তব্য করেন। সুমিতা দাস বলেন, তার মা রোকেয়ার সেই বাণী জানতেন না, তবুও তার মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অথচ, তার জন্মের অনেক আগে সেভাবেই মহিলাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে গেছেন বেগম রোকেয়া। তাই সুমিতা দাস বেগম রোকেয়াকে মহিলাদের শুধু নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করাই নয়, সমাজে মহিলাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলে অভিহিত করেন। সৈয়দ রেজাউল করিম পুলিশি কর্মজীবনের মধ্যে তার সাহিত্যকর্ম চালানো নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা তুলে ধরেন। তবে বিভিন্ন বক্তা স্বাধীনতা পরবর্তীতে একটা বড় শূন্যতার পর পুনরায় রাজ্যের বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে যে সাহিত্য চর্চার জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে অনেকেই আলোকপাত করেন। এ বিষয়ে, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার বেশ কয়েকজনের নিরলস পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরেন। ‘রাহিলা’ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রব খান বলেন, তার মা প্রথাগত শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু তার মা স্বাধীনতা সংগঠন অনুশীলন সমিতিকে নিয়মিত গোপন তথ্য সরবরাহ করতেন। দেশের প্রতি সেই অনুরাগ থেকেই বাংলা ভাষা চর্চায় তার প্রবেশ বলে তিনি জানান। এছাড়া প্রবীণ সাহিত্যিক মুন্সী আবদুর রহিম কাফেলা যুগের অবদানের কথা তুলে ধরেন। প্রবীণ প্রবান্ধিক তথা প্রাক্তন পুলিশ অফিসার মহিউদ্দিন সরকার তার বক্তব্যে আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের এ ধরনের প্রয়াসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ড. আমজাদ হোসেন আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের ভাষা চর্চা নিয়ে উদ্যোগের নানা কথা উপস্থাপন করেন। তবে, কোনও রাখঢাক না রেখে সাহিত্য চর্চার বিকাশে ও সাময়িকী প্রকাশের ক্ষেত্রে অর্থ সঙ্কট প্রধান অন্তরায় তা উঠে আসে বিভিন্ন বক্তাদের মধ্যে। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ড. সুরঞ্জন মিদ্দে, লেখক সোনা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। নিয়ে আলিয়া সংসদের প্রকাশনা বিভাগের কর্ণধার হাফিজুর রহমান ও ইনাস উদ্দিন ‘উজ্জীবন’-এর নিয়মিত প্রকাশে বেশি করে গ্রাহক হওয়ার আহ্বান জানান। বিশেষ করে সমগ্র অনুষ্ঠানের সুচারু সঞ্চালক ড. সাইফুল্লা জানান, অর্থনৈতিক দুরবস্থাই আলিয়া সংস্কৃতি সংসদের ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই সেক্ষেত্রে সবাইকে উদারভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকের কথা জাাননো সহ সাহিত্য চর্চার বিকাশে নীরবে যেভাবে একরামূল এইচ শেখ কাজ করে যাচ্ছেন তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct