বিশ্বের ইসলামি শাসনের প্রথম দিকে আব্বাসীয় শাসক হারুণ-আল রশিদ ও তাঁর পুত্র মামুনের প্রচেষ্টায় ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানের প্রসারের এক প্রগতিশীল চিন্তাধারার উদয় হয়েছিল। সেই সঙ্গে বিজিত ও বিস্তারিত সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য এবং তার স্থায়িত্বের জন্য অবশ্যই কোনো কিছু একটা খোলা মন নিয়ে করার দরকার ও ছিল। ভাগ্যক্রমে বিজিত দেশগুলি থেকে উপলব্ধ গ্রিক, ফার্সি, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান লেখনি প্রভৃতি শাসকবর্গ ও তাদের অধীনস্ত বুদ্ধিজীবীদেরকে প্রভাবিত করেছিল। তারপরই সেইসব নানান বিষয় ভিত্তিক বইগুলির আরবি ভাষায় অনুবাদ অবিরাম চলতে রইল। তাদেরই প্রতিষ্ঠিত জ্ঞান-কেন্দ্রে (House of Wisdom, বায়তাল-হিকমা) আমন্ত্রিত জ্ঞান-পিপাসু মুসলিম অমুসলিম বিভিন্ন বুদ্ধিজীবিগণ ওই সব সাহিত্যর উপর গবেষণা ও জ্ঞান চর্চা করতে লাগলেন। মুসলিম রাষ্ট্রে নতুন জাগরণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ হতে রইল। অনেকেই দাবি করে থাকেন যে গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানের অনুবাদের ফলস্বরূপেই আব্বােসীয় শাসনকালে মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও বৈজ্ঞানিকগণ এত উন্নতি করতে পেরেছিলেন, এটা পুরো সঠিক নয়। অ্যারিস্টটল, প্লাটো, সক্রেটিসদের দর্শস, লেখনি, থিওরি অবশ্যই মুসলি,ম বুদ্ধিজীবীদের চোখ খুলে দিয়েছিল। তাদেরকে হাত ধরে চলতে অবশ্যই প্রভাবিত করতে পেরেছিল, এগুলো অস্বীকার করার কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, ওই মুসলিম বিজ্ঞানীদের মনে যদি আত্মবোধ, দায়িত্ববোধ না থাকত, তারা যদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, অক্লান্ত পরিশ্রমী ও অনুপ্রাণিত না হতেন, যদি শাসকদল অর্থ, সাধন ও সর্বপ্রকার সাহায্য ও সমর্থন না দিতেন, যদি জ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালনা সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত না হত তাহলে তারা চলতে শিখতে গেলেও পড়ে যেতেন এবং দৌড়াতে পারতেন না। কিন্তু তাদের মধ্যে হিকমত, হিম্মত, কার্যক্ষমতা, দক্ষতা এবং চ্যালেজ্ঞ নেবার মতো সাহস ছিল বলেই তারা সফল হয়েছিল। বাগদাদের জ্ঞান-কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত অনেক মুসলিম বিদ্বান এবং বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তাদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার ও অবদান আজও উল্লেখযোগ্য। জাবির ইবনে হাইয়্যান (৭২১-৮১৫ খ্রি.) এক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তিনি রসায়ন শাস্ত্র (Chemistry)এর উপর গবেষণা করে সালফুরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি ঊর্দ্ধপাতন (sublimation), রিডাকশান এবং ডিসটিলেশন পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছিলেন।মুহাম্মদ ইবনে মূসা আল-খোয়ারিজমী (৭৯০-৮৫০খ্রি.) ছিলেন নবম শতাব্দীর এক বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং তাকে অ্যালজেবরা এবং কম্পিউটারের পিতাও বলা হয়। তিনি অ্যালজেবরা, জ্যামিতি (Geometry), ভূগোল, জ্যোর্তিবিদ্যা (Astrology)র উপর অনেক গবেষণা করেছিলেন। তার ‘হিসাব আল জবর ওয়াল মুকাবালা’ সবচেয়ে চর্চিত ছিল। আল-খোয়ারিজমী প্রথমবার নির্ভুলভাবে পৃথিবীর পরিধি মেপেছিলেন - যেটা ছিল ২৩০০০ মাইল। আবু হানিফা দিনাওয়ারি (৮১৫-৮৯৫ খ্রি.) এক বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি এই বিষয়ের উপর অনেক উল্লেখনীয় কাজ করে গেছেন। তিনি একটি বই লিখেছিলেন যার নাম ছিল ‘কিতাবাল নাবাত (Book of Plants)। এর ছয়টি খণ্ড ছিল, কিছু খণ্ড নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যেসব খণ্ড পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে ৬৩৭ টি গাছ-গাছড়ার নাম উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, পুরো খণেডর মধ্যে হাজার হাজার গাছের আরও নাম থাকার সমূহ সম্ভাবনা। আল-বাত্তানে (৮৫০-৯২২ খ্রি.) সর্বপ্রথম সৌরবর্ষের সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি একটি টেবিল অফ টোলেডো (Table of Taledo) আবিষ্কার করেছিলেন যার সাহায্যে সূর্যের, চন্দ্রের এবং বিভিন্ন গ্রহের গতিবিধির ভবিষ্যৎ বাণী করা যেত। পরবর্তীকালে জ্যোতিষচর্চায় (Astrology) কোপারনিকাস ওই টেবিলেরই সাহায্য নিয়েছিলেন।
আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজি (৮৬৫-৯২৫ খ্রি.) বাগদাদে হাসপাতালে প্রধান চিকিৎসকের পদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনিই প্রথম গুটিবসন্ত ও হামের লক্ষণগুলি চিহ্নিত করেছিলেন এবং এই দুই রোগের পার্থক্যগুলি মানুষকে বুঝিয়েছিলেন। তার বই ‘কিতাবাল জুদারি ওয়া আল হাসবাহ’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তারই আবিষ্কৃত ফরমুলার ভিত্তিতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনন্য গবেষণা হয়েছে। তারপরই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে গুটিবসন্ত রোগকে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি দুই শতেরও বেশি বই লিখে গেছেন। তিনিই প্রথম মানসিক রোগীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা ওয়ার্ড খুলেছিলেন তাদের পৃথকভাবে চিকিৎসা করার জন্য। রোগীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই বিষয়েও তিনি চিকিৎসকদের জন্য হেদায়েতনামা লিখেছিলেন। এছাড়া, ফারমাকোলোজি, নিউরোলোজি, সাইকোসোমাটিক মেডিশিন এবং মেলিক্যাল এথিক্স-এর উপরও অনেক কাজ করে গেছেন। আবিসেন্না-র (৯৮০-১০৩৭ খ্রি.) পুরো নাম ছিল আবু আলি আল হুসাইন ইবনে আবদাল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক এবং দার্শনিক। তাঁর লেখা বই ‘কিতাবাল শিফা’ এবং আল-কানুন-ফি-আল-তিব (The Canon of Medicine) রোগাক্রান্ত মানুষদের জন্য এবং চিকিৎসা জগতে জড়িত চিকিৎসকদের জন্য লাভবান প্রমাণিত হয়েছিল। এছাড়া, তিনি তর্কশাস্ত্র, গণিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানের উপরও অনেক বই লিখেছেন।মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম ইবনে বাসাল (১০৫০-১০৮৫ খ্রি.) এক বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ এবং কৃষি বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে উদ্ভিদ বিদ্যা ও কৃষি বিদ্যাতে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। দেশে ফিরে এসে মুসলমানদেরকে উন্নতমানের চাষ-বাস করা শেখান। শাক-সব্জি, মূলো, গাজর, বিভিন্ন রকমের মশলা, গাছ-পালা লাগানো, ফলন কিভাবে উন্নতমানের হবে ইত্যাদি প্রবর্তন করেছিলেন। যার ফলে আরব দেশে ও ওই সময় প্রথমবার কৃষি বিপ্লব ঘটেছিল। তিনি সেভিলে খলিফা আল-মুতামিদের জন্য একটা অতি সুন্দর বাগিচা তৈরি করেছিলেন। আবু-ই-খায়র আল-ইশবিলি (১০৬৯-১০৯১ খ্রি.) ও একজন উদ্ভীদবিদ ছিলেন। জয়তুন গাছ কিভাবে লাগাতে হয় এবং তার রক্ষাণাবেক্ষণ কিভাবে করতে হয় সে বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ইসমাইল ইবনে জাজারি (১১৩৬-১২০৬ খ্রি.) জাজিরার আর্তুকিদ বংশের একজন বিখ্যাত ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনয়ার এবং বিভিন্ন বিষয়ের উদ্ভাবক। তাকে যন্ত্রমানব নির্মাণ বিদ্যার এবং আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পিতা বলা হয়। তিনি একটি ওয়াটার ব্লক আবিষ্কার করেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে একশোর উপরে যান্ত্রিক ডিভাইস-এর বর্ণনা করে গেছেন। জাজারির ফরমুলার ভিত্তিতে পরবর্তীকালে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অগ্রগতি ঘটেছে। হাত ধোয়ার ফ্ল্যাশ সিস্টেমও আবিষ্কার করেছিলেন। সভ্যতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে, মানবজাতি লাভবান হয়েছে এবং পরবর্তীকালের প্রজন্মকে বিকাশ ও উন্নতির আলো দেখিয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও তাদের অনন্য আবিষ্কার ওই স্বণর্যুগেরই প্রতিফলন, কারণ, মুসলিম বৈজ্ঞানিকগণের লিখিত বই সমুহ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ল্যাটিন, ইংরাজিও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
শেখ হাফিজুর রহমান.....
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct