আগামী নির্বাচনে এরদোগানের জন্য এই ভূমিকম্প মোকাবেলার সাফল্য বা ব্যর্থতা একটি বড় উপলক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে। তুরস্কের সর্বসাম্প্রতিক জনমত জরিপে এরদোগানের ক্ষয় হওয়া জনমত আবার চাঙ্গা হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর বিরোধী পক্ষের নানা ইস্যুতে বিভাজনের প্রভাবও পড়তে পারে নির্বাচনে। এই জোটে উগ্র সেকুলার ও কট্টর ইসলামিস্ট এবং ক’দিন আগ পর্যন্ত সরকারে থাকা লোকদের দলও রয়েছে। ভুমিকম্পের পরও একেপি একক দল হিসেবে এখনও প্রথম স্থানে রয়েছে। এই নতুন মোড় নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী।
তুরস্কের প্রলয়ঙ্করী ভূকম্পনের রেশ না কাটতেই নির্বাচনের ইস্যু আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ভূমিকম্পের কারণে নির্বাচন এক বছর পিছিয়ে যেতে পারে বলে বিরোধী পক্ষের জল্পনার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে। একই সাথে তিনি উপদ্রুত এলাকায় এক বছরের মধ্যে সবার জন্য বাড়ি করার কর্মসূচির কথাও জানিয়েছেন। তুর্কি রাজনীতির উত্থান-পতন ১৪ মে নির্ধারিত এই নির্বাচন পেছানোর গুজব নাকচ হওয়ার সাথে সাথে তুর্কি রাজনীতিতে নানা ধরনের উত্থান-পতনের ঘটনাও ঘটছে। ছয়টি বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট ৩ মার্চ তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য সভায় মিলিত হয়। এ সভায় ডানপন্থী দল গুড পার্টি ছাড়া বাকি পাঁচটি দল সিএইচপি প্রধান কিলিকদারুগ্লুকে বিরোধী জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে অনুমোদন দেন। গুড পার্টির প্রেসিডেন্ট মেরেল আকসেনার জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা ইস্তাম্বুলের মেয়র ইকরাম ইমামোদুগ্লু অথবা আঙ্কারার মেয়র মানসুর ইয়াবাসকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করার দাবি জানান। তার প্রস্তাবে বাকি পাঁচ দল সম্মত না হওয়ায় তিনি জোটের কার্যক্রম থেকে কার্যত বেরিয়ে যান। পরের দিন বিরোধী দলগুলোর সভায় ৫ দলের প্রধান অংশ নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেরেল আকসেনার আবার বিরোধী জোটে ফিরে এসে কিলিকদারুগ্লুর প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার ব্যাপারে সম্মত হন। বিরোধী দল নির্বাচনে জিতলে ইমামোদুগ্লু এবং ইয়াবাসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করার জন্য তার প্রস্তাব গ্রহণ করে আকসেনারের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের বিরোধী দলগুলো কয়েক মাসের বিবাদের অবসান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে যৌথ প্রার্থী মনোনয়ন দিতে সম্মত হয়েছে। ৬ মার্চ বিরোধী জোটের বৈঠকের পর ফেলিসিটি পার্টির (এসপি) চেয়ারম্যান টেমেল কারামোল্লাওলু রাষ্ট্রপতি পদে বিরোধী জোটের প্রার্থী হিসেবে কামাল কিলিকদারুগ্লু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মর্মে ঘোষণা করেন। এই জোটে কামালপন্থী সেক্যুলার দল সিএইচপি, ডান জাতীয়তাবাদী দল গুড পার্টি (আইপি) ইসলামিস্ট ফেলিসিটি পার্টি (এসপি), একেপি থেকে বিচ্ছিন্ন ফিউচার পার্টি ও ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড প্রগ্রেস পার্টি এবং ডেমোক্র্যাট পার্টি (ডিপি) রয়েছে। তাদেরকে সাধারণভাবে ‘টেবল অব সিক্স’ বলা হয়। বিরোধী ব্লকের যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থায় রূপান্তরের বিষয়ে সাংবিধানিক সংশোধনীগুলো সম্পন্ন এবং কার্যকর করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
২০১৭ সালের গণভোটে তুরস্কে সংসদীয় ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং ২০১৮ সালে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।এরদোগান ৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছেন যে, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন আগের ঘোষিত তারিখ অনুসারে অনুষ্ঠিত হবে আর এ ঘোষণা অনুসারে ১০ মার্চ থেকে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। ফলে এখন থেকেই তুরস্কে জোর নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হবে। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এরদোগান বলেছেন, সাম্প্রতিক বিপর্যয় ও এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য তুরস্কে একটি শক্তিশালী সরকার ও জোরালো রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন। গত মাসে পরপর দু’টি ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিধ্বস্ত হয় এবং ৪৬ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। শক্ত প্রতিযোগিতা এবারের নির্বাচনে একটি শক্ত প্রতিযোগিতা হবে বলে আশা করা হচ্ছে যদিও সাম্প্রতিক কিছু জরিপে এরদোগান বিরোধী প্রার্থীর চেয়ে স্পষ্টত এগিয়ে রয়েছেন। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুসারে ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) ভোট তিন পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে ৪১ শতাংশ ছাড়িয়েছে।তুরস্কে ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের বিরুদ্ধে ছয় দলের বিরোধী নেশন জোটের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। কুর্দিদের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি), পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে নেশন অ্যালায়েন্সের বাইরে রয়েছে। সাইডলাইনে দলটি নিষিদ্ধ হওয়ার একটি মামলায় লড়াই করা সত্ত্বেও তারা নিজস্ব প্রার্থী খুঁজছে। অনেকে এইচডিপিকে পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য নিন্দিত দল মনে করে। দলটির প্রধানত কুর্দি ভোটার ভিত্তির প্রতি সিএইচপির বিশেষ আগ্রহের জন্য এইচডিপিকে বিরোধী জোটের ‘লুকানো অংশীদার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এইচডিপির সাথে সিএইচপির সমঝোতার কারণে বিগত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার একে পার্টির প্রার্থী সিএইচপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন।
মধ্য বাম ধারার দল সিএইচপি প্রধান কিলিকদারুগ্লু খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধী দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কামাল আতাতুর্কের উগ্র সেক্যুলারিজম দলটির মূলনীতি, তবে সম্প্রতি হিজাবের ব্যাপারে দলের কট্টর অবস্থান থেকে সরে এসেছে নেতৃত্ব। সিএইচপি প্রধান শিয়াদের একটি শাখা আলভি ধর্মমতে বিশ্বাসী একসময়ের আমলা হিসেবে সরকারি অফিসে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। অর্থনীতির ব্যাপারে তাকে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হয়।অবশ্য তুর্কি রাজনৈতিক মহলে কিলিকদারুগ্লুর এই মনোনয়ন এরদোগানের জন্য বিশেষ সুবিধা এনে দেবে বলে ধারণা করা হয়। এরদোগান ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে বলে বিভিন্ন জনমত জরিপে উঠে আসে, বিশেষত তুর্কি মুদ্রা লিরার নজিরবিহীন অবমূল্যায়নে চার লিরায় এক ডলার পাওয়ার অবস্থা থেকে এখন ১৯ লিরার কাছাকাছি চলে এসেছে ডলারের দাম। লিরার দাম পড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতির ওপর। এক বছরের ব্যবধানে এই মূল্যস্ফীতি ৫৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। এরপর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূকম্পনে ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনা এরদোগানের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। শত বছরের ইতিহাসে এত বড় ভূমিকম্প তুরস্কে আর হয়নি। প্রচণ্ড তুষারপাত ও শীতের মধ্যে রাতে ঘটা এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক অঞ্চলে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছতে পারেননি। তবে সামগ্রিকভাবে পুরো তুর্কি জাতিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় সম্পৃক্ত করার মতো পদক্ষেপ নিয়ে সরকার সেই সমালোচনা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।নির্বাচনে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা আগামী নির্বাচনে এরদোগানের জন্য এই ভূমিকম্প মোকাবেলার সাফল্য বা ব্যর্থতা একটি বড় উপলক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে। তুরস্কের সর্বসাম্প্রতিক জনমত জরিপে এরদোগানের ক্ষয় হওয়া জনমত আবার চাঙ্গা হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। আর বিরোধী পক্ষের নানা ইস্যুতে বিভাজনের প্রভাবও পড়তে পারে নির্বাচনে। এই জোটে উগ্র সেকুলার ও কট্টর ইসলামিস্ট এবং ক’দিন আগ পর্যন্ত সরকারে থাকা লোকদের দলও রয়েছে। তুরস্কে একই দিনে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সূচি রয়েছে। একেপি একক দল হিসেবে এখনো প্রথম স্থানে রয়েছে। এরপর সিএইচপির অবস্থান। এই দলটির জনপ্রিয়তায় ইতিবাচক বা নেতিবাচক খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। একেপির হারানো কয়েক শতাংশ ভোট যুক্ত হয়েছে গুড পার্টির সাথে। তবে একেপি ও ডান জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপির পিপলস জোট যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে রয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct