রোজা হল একটি ইবাদত এবং মুসলমানের জন্য একটি অপরিহার্য ইবাদত। আল্লাহতায়ালা বলেছেন: হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩) ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তির অন্যতম একটি রোজা। ওমর (রা.) বলেন— আমরা রাসুল সা.-এর সাথে বসেছিলাম, একজন ব্যক্তি আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন, যার পোশাক ছিল অধিক শুভ্র এবং চুল ছিল ঘন কালো। তার মাঝে ভ্রমণের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না। আমরা কেউ তাকে চিনতাম না। তিনি হেঁটে এসে নবীজি সা.-এর পাশে বসলেন। তার হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে এবং নিজের হাত তার উরুতে রেখে বললেন : ‘হে মুহম্মদ, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।’ রাসুল (সা.) বললেন- ‘ইসলাম হচ্ছে এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহম্মদ আল্লাহর রাসুল, নামাজ আদায় করা, জাকাত দেয়া, রমজানে রোজা রাখা এবং সামর্থ্য থাকলে (আল্লাহর) ঘরে হজ্ব পালন করা। তিনি বললেন, ‘আপনি সত্য বলেছেন।’ এবং আমরা চমৎকৃত হলাম যে তিনি নিজেই প্রশ্ন করছেন এবং নিজেই সত্যায়ন করছেন। (বুখারি, কিতাবুল ইমান, হাদিস ৪৮) ইসলামে রোজা মানে হল— নিয়তের সঙ্গে নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ে রোজা ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকা। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন— ‘শাব্দিক অর্থে রোজা অর্থ বিরত থাকা হলেও শরিয়তে রোজা মানে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিবৃত থাকার পদ্ধতি অনুসারে বিশেষ কয়েকটি বিষয় থেকে বিরত থাকা নির্দিষ্ট শর্ত মেনে।’ (ফাতহুল বারি, কিতাবুস সাওম, বাবু উজুবিস সাউমি রামাদান, পৃষ্ঠা ১২৩) সুতরাং রোজার জন্য নির্দিষ্ট সময় ও পদ্ধতি রয়েছে। কী সেই পদ্ধতি? ফকিহগণ বলেন : সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সঙ্গে যাবতীয় যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। (তাহাবি, আহমদ ইবনে ইবরাহিম)
কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়; বরং একই সঙ্গে যৌন-সম্ভোগ থেকেও বিরত থাকতে হয়। আবার পানাহার ও যৌনতা থেকে যে-কেউ বিরত থাকলেই তাকে রোজা বলা হবে না, বরং তাকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক বোধশক্তিসম্পন্ন মুসলিম হতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে নিয়তের সঙ্গে তাকে রোজা শুরু করতে হবে, এর মধ্যে তারাবিহ ও সাহরির মতো ইবাদত পালন করতে হবে এবং ইফতারের নির্দিষ্ট সময়ে আবার পানাহার গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাকে সমাপ্তিও ঘোষণা করতে হয়। অনশন বা উপবাসের সার্বজনীন অর্থ হল- কেবল সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা। রোজার বিধানকে অন্য বিধানের সঙ্গে কিছুতেই মেলানো যায় না; কাছাকাছিও ভাবা যায় না। ইসলাম রোজার পূর্বপ্রচলিত ধারায় ব্যাপক সংস্কার সাধন করেছে এবং ধারণা ও বিধানগত বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। যেমন ইহুদিদের দৃষ্টিতে রোজা ছিল বেদনা ও শোকের প্রতীক। ইসলাম এই হতাশাব্যঞ্জক ধারণাকে স্বীকার করেনি। আবার কোনো কোনো প্রাচীন ধর্মমতে রোজা এক বিশেষ শ্রেণির জন্য পালনীয় ছিল। কিন্তু ইসলাম রোজাকে সব শ্রেণিবিভক্তি ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে এক সার্বজনীন রূপদান করেছে। ইসলামের বিধানে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জন্য রোজা রাখা ফরজ। তা ছাড়া পূর্বে উম্মতদের প্রতি নির্দেশ ছিল যে, এশার নামাজ আদায় করার পর যখন তারা শুয়ে যেত, তখন তাদের ওপর পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হারাম হয়ে যেত। ইসলাম আসার পরে সেখানে সাহরি ও সুবেহ সাদিক সম্পর্কিত বিধান যোগ হয়েছে। এটাও মনে রাখতে হবে, যদিও বিভিন্ন ধর্মে অনশনের রীতি রয়েছে, কিন্তু রাসুল (সা.) রোজাকে অন্যান্য ধর্মের রীতির সঙ্গে বৈপরীত্য বজায় রাখার পন্থা গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি রমজানের আমলের ক্ষেত্রে আহলে কিতাবিদের সঙ্গে বৈপরীত্য রেখেছেন।
তিনি বলেছেন : দীন বিজয়ী হবে, যে-যাবত মানুষ দ্রুত ইফতার করবে। কারণ ইহুদি-নাসারারা তা বিলম্বে করে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ২/৫০১)
অন্য হাদিসে এরশাদ করেন : যে অবধি মানুষ দ্রুত ইফতার করবে (অর্থাৎ সময় হওয়া মাত্রই), ভালো থাকবে। তোমরা দ্রুত ইফতার কর। কারণ ইহুদিরা তা বিলম্বে করে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৬৯৭)
তিনি আরও বলেন: আমাদের ও আহলে কিতাবিদের রোজার মাঝে পার্থক্য হল- সাহরি গ্রহণ। (মুসলিম, হাদিস ১০৯৬) ইসলাম ধর্মের রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা। তার বৈশিষ্ট্যগুলো পৌত্তলিক ও বিকৃতকারী আহলে কিতাবিদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। রোজা ইত্যাদি ক্ষেত্রে; তাই রাসুল ছিলেন পার্থক্য বজায় রাখার নিদর্শন ও নির্দেশক। উম্মত আজ সাংস্কৃতিক, চেতনাগত এক ব্যাপক দৌর্বল্যে আক্রান্ত। সর্বক্ষেত্রে অন্যের পদাঙ্ক অনুসরণই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র ভবিতব্য। অমুসলিম ও পৌত্তলিকদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য গ্রহণ, সন্দেহ নেই, তার জন্য ছিল সর্বাধিক প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। ধর্ম ও ধর্ম-চেতনা— যা উম্মাহের জন্য বৈশিষ্ট্যের মর্যাদা প্রাপ্ত, তাতে নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
মনযূরুল হক........
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct