দেশজুড়ে এত দিন ধরে নির্বাচনী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় ছিল গণতন্ত্র রক্ষার প্রধান আলোচ্য বিষয়। এবার তা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল ভারতের নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কারের বিষয়টি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম যোশেফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, তা পালিত হলে দেশের নির্বাচন পরিচালনাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার সাধনের আশা করছে দেশের সব প্রধান বিরোধী দল। এ নিয়ে লিখেছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেশজুড়ে এত দিন ধরে নির্বাচনী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায় ছিল গণতন্ত্র রক্ষার প্রধান আলোচ্য বিষয়। এবার তা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠল ভারতের নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগপদ্ধতির সংস্কারের বিষয়টি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে এম যোশেফের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন, তা পালিত হলে দেশের নির্বাচন পরিচালনাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার সাধনের আশা করছে দেশের সব প্রধান বিরোধী দল। সুপ্রিম কোর্ট গতকাল জানিয়ে দেন, সংবিধান মেনে আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও দুই নির্বাচন কমিশনারকে নিযুক্তি দেবে তিন সদস্যের এক কমিটি। সেই কমিটিতে থাকবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলের নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। লোকসভার বিরোধী নেতার মর্যাদা পেতে গেলে মোট আসনের (৫৪৩) এক–দশমাংশ পাওয়া জরুরি। তা কোনো দলের না থাকলে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছেন, সর্ববৃহৎ বিরোধী দলের নেতা ওই কমিটিতে থাকবেন। ওই রায়ের পর কংগ্রেস দাবি করেছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা সবাই পদত্যাগ করুন। বর্তমান তিন সদস্যকে নতুন কমিটি আবার মনোনীত করতে পারে। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই সম্মান জানানো হবে। এ রায় যুগান্তকারী হলেও কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দল বিজেপি গত বৃহস্পতিবার কোনো মন্তব্য করেনি। সেই কারণে একটা ক্ষীণ আশঙ্কা বিরোধী রাজনৈতিক মহলে ছড়িয়ে পড়েছে। শঙ্কা, সরকার এ রায় মানবে তো?
সংবিধানের ৩২৪ (২) অনুচ্ছেদে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিযুক্তিসংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। ঘটনা হলো, স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর কেটে গেলেও কোনো সরকার সেই আইন তৈরিতে আগ্রহী হয়নি। ফলে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কাদের হাতে থাকবে, কেন্দ্রীয় সরকারই তা একতরফাভাবে ঠিক করে এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল পছন্দের ও অনুগত আমলাদের বেছে নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় আইন তৈরির ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, যতক্ষণ তা না হচ্ছে, তিনজনের কমিটি সেই দায়িত্ব পালন করবে। শঙ্কা হল, আইন করে সরকার নিযুক্তির পূর্ণ ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে পারে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের অন্তর্ভুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইনসভা ও বিচার বিভাগের সংঘাত নতুন আকার নিতে পারে। সেই সংঘাতের কিছু নমুনা ইতিমধ্যে পাওয়াও গিয়েছে সুপ্রিম ও হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও বদলির অধিকারকে কেন্দ্র করে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, এমনকি উপরাষ্ট্রপতিকেও এ কথা বলতে শোনা গিয়েছে, সংসদই সবার ওপরে। আইনমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। সংবিধান না সংসদ—প্রাধান্য কার বেশি, সেই বিতর্ক উঠে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিরোধীরা দাবি করেছেন, নির্বাচন কমিশনারদের পাশাপাশি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) প্রধান কর্তার নিযুক্তিও সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত তিন সদস্যকে দেওয়া উচিত। যে কারণে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা দরকার, ইডির ক্ষেত্রেও তা জরুরি। তা না হলে অপব্যবহার রোখা কঠিন হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের বিপন্নতাও কাটবে না। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশিত তিনজনের কমিটি এখন সিবিআই ডিরেক্টর, মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার (সিভিসি), মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং লোকপাল নিয়োগ করেন।
সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৮ পৃষ্ঠার রায়ে রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তির মাত্রাতিরিক্ত রমরমার কথা উল্লেখ করে এক হাত নিয়েছেন মিডিয়ার একাংশকে। বিচারপতি যোসেফ রায় পড়ার সময় বলেছেন, গণমাধ্যমের একাংশ নিজেদের দায়িত্ব ভুলে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে। প্রবল অর্থশক্তি যেমন নির্বাচনে প্রভাব খাটাচ্ছে, তেমনই বেড়ে চলেছে পেশিশক্তির তাণ্ডব। ফলে ভোটারদের আস্থা টলে যাচ্ছে। রায়ে বলা হয়েছে, এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়োজন এমন এক নির্বাচন কমিশন, যা ভয়ডরহীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে, দৃঢ়তার সঙ্গে স্বাধীনভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। বিচারপতি যোসেফ বলেছেন, কোনো ব্যক্তি তাঁর নিয়োগকর্তা বা সরকারের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে কিছুতেই নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। যিনি সর্বার্থে স্বাধীন, তিনি কিছুতেই ক্ষমতাসীনের প্রতি অনুগত থাকবেন না। নির্বাচন কমিশন আইনের শাসন সুনিশ্চিত করতে না পারলে গণতন্ত্রের বিপন্নতাও কাটবে না। বিচারপতি যোসেফ তাঁর রায়ে বলেছেন, ক্ষমতাসীন কীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকবে, সেই চেষ্টা সব সময় চালায়। এমন দল সব সময় চাইবে কমিশন তার অনুগত থাকুক।সুপ্রিম কোর্টে এ মামলার শুনানির সময় বিচারপতি যোসেফ অ্যাটর্নি জেনারেল আর বেঙ্কটরামানির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচন বিধিভঙ্গের অভিযোগ উঠলে কমিশন কী ব্যবস্থা নিতে পারবে? প্রশ্নটি সংগতই শুধু ছিল না, নির্বাচন কমিশনের চরিত্র কতখানি নমনীয়, তার প্রতি মারাত্মক ইঙ্গিতপূর্ণও ছিল। কেননা, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের মোট পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছিল। তৎকালীন কমিশন তা আমলে নেয়নি। দুজনকেই ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছিল। অন্যতম নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধমত পোষণ করেছিলেন। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন। সেই অপরাধে তাঁর পরিবারকে চূড়ান্ত হেনস্তার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। ভোট পর্ব শেষ হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও বোনের বিরুদ্ধে আয়কর বিভাগ আয়বহির্ভূত সম্পত্তি থাকার অভিযোগ এনেছিল। ইডি তদন্ত শুরু করেছিল তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে। লাভাসা মন্তব্য করেছিলেন, ‘সততার মূল্য দিতেই হয়। সে জন্য প্রস্তুতও থাকতে হয়।’সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন কমিশনে চলমান যুগের অবসান ঘটবে কি? কখনো কি আবার ফিরে আসবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ, আপাদমস্তক নিরপেক্ষ, স্বাধীন ভারতের একমাত্র নির্ভীক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পরিচিত টি এন সেশনের যুগ? ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের নজর এখন সেদিকেই।
সৌজন্যে: প্র. আ.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct