এই সময়ে যেখানে পরবর্তীসাধারণ নির্বাচনের জন্য তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তেজনামুখর হয়ে থাকার কথা সেখানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিক্ষত দেশটি এখন শোকে বিহ্বল। সর্বশেষ খবর অনুসারে শুধু তুরস্কেই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। ঠিক এ সময় আরেকটি ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দেশটির ওপর। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়্যেপ এরদোগান ভূমিকম্প নিয়ে শিগগিরই ভাঙা শহরগুলো পুনর্গঠন কাজ শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। নতুন এই নতুন চ্যালেঞ্জা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ শেষ কিস্তি।
টুইটারের সাথে আলোচনার পরে ‘বিভ্রান্তি’ সীমিত করতে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতির পর অবশেষে টুইটার খুলে দেয়া হয়। সর্বশেষ খবর অনুসারে, তুরস্কে উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে; আরো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। সরকার এখন পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেছে। এক বছরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। একদিকে ধ্বংসাবশেষ সরানো হচ্ছে। অন্য দিকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করা হচ্ছে। পুরো পুনর্বাসন শেষ করতে ২৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হতে পারে। প্রাথমিক কাজের জন্য এক রাতের বিশেষ আয়োজনে ছয় বিলিয়ন ডলার তোলা হয়েছে যেখানে নাগরিকদের পক্ষ থেকে ৫০ লিরা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে আরো ১০ বিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে বলে একটি সূত্র উল্লেখ করেছে। এরদোগান বনাম অন্যরা ভূমিকম্পের জাতীয় দুর্যোগের পর তুর্কিয়েদের ভাবনায় এখন আর নির্বাচনের বিষয়টি সেভাবে নেই। ১৪ মে যে সাধারণ নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করা আছে সেটি এই সময়ে হবে কিনা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ভূমিকম্পজনিত কারণে ১০ প্রদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সেসব সব অঞ্চলে নির্বাচনী কার্যক্রমের কোনো পরিবেশ নেই। তবে সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জুনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসাবে মাস খানেক সময় পেছানো যেতে পারে নির্বাচন। আর এর ব্যতিক্রম হতে পারে পুরো দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হলে। সে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ। তবে সরকার বা বিরোধী উভয় পক্ষের মাথায় নির্বাচনের বিষয়টি রয়েছে বলে মনে হয়। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তুরস্কের এবারের নির্বাচন অনেক কঠিন হতে পারে। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেপ এরদোগান ও তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং এর মিত্র ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টির (এমএইচপি) বিজয় দেশকে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের দিকে চালিত করার সুযোগ এনে দেবে এরদোগানকে। গত দুই দশকের শাসনে তুরস্ক ভেতর থেকেই অনেকখানি পাল্টে গেছে। শাসনের ধারাবাহিকতা চললে শিক্ষা গবেষণা প্রযুক্তি প্রতিরক্ষা ও শিল্পায়নে আরো সুদৃঢ় ভিত্তি তৈরি হবে তুরস্কের জন্য। এটি তুর্ক অঞ্চলের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত করবে তুরস্ককে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বন্ধনে থাকা শক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভেতর থেকে তুরস্কের জন্য এটি কামনা করে না। এ জন্য ন্যাটোর মধ্যে গ্রিস যে সুবিধা পায় তুরস্ক তা পায় না। তুরস্কে বিরোধীদের বিজয় ঘটলে সেটি চলমান এই ধারায় ছেদ আনবে। দেশটির প্রশাসনে পাশ্চাত্যের প্রভাব আবার বাড়বে। রাষ্ট্রের মধ্যে সেনাবাহিনীসহ মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কামালবাদের প্রভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। এ কারণে এরদোগানের শাসনের অবসানের ব্যাপারে ইউরোপ আমেরিকার সরকারগুলোর প্রায় অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। এ জন্য অর্থনীতিকে একসময় লক্ষবস্তু করে লিরার ব্যাপক দরপতন ঘটানো হয়। ভূমিকম্পের পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেকোনো ধরনের ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে আরেক দফা সুযোগ এনে দিতে পারে। তবে তাদের জন্য প্রধান সমস্যা হলো তুর্কিয়ে জাতির মধ্যে যেকোনো সঙ্কটে একত্র হওয়ার প্রবণতা। ভূমিকম্পের দুর্যোগে তুরস্কের জনগণ রাজনীতি ভুলে গিয়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্য দেশের দুর্যোগে তুরস্ক যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে তার বিনিময় হিসেবে সে সব দেশকে এবার আঙ্কারা নিজেদের দুর্যোগে পাশে পাচ্ছে।
এর বিপরীতে দেশী-বিদেশী পৃষ্ঠপোষকদের চেষ্টা সত্ত্বেও বিরোধীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফাটল এখনো রয়ে গেছে। তারা ছয় দলের ফ্রন্ট করে এখনো রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী বাছাই করতে পারেনি। তবে এর মধ্যে তাদের জন্য কিছু সুবিধাও রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী নিয়ে হতাশা রয়েছে তুর্কিয়েদের মধ্যে, এর বাইরে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ চাপ। একই সময়ে, বিরোধীদের অবশ্যই আদালত ব্যবস্থা, নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং প্রসিকিউটরদের মুখোমুখি হতে হবে যারা রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনুকূল থাকবে বলে মনে করা হয়। এর পাশাপাশি গণমাধ্যম জগতেও বিরোধীদের প্রভাব কমে গেছে। এ ছাড়া বিরোধী পক্ষে ঐতিহ্যবাহী তুর্কিয়ে জাতীয়তাবাদী এবং কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) মধ্যে দূরত্ব রয়েছে অনেক। ইতোমধ্যেই, এইচডিপির প্রধান নেতারা হয় কারাগারে অথবা বিচারের মুখোমুখি। নির্বাচনের আগে এইচডিপি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে জনমত জরিপে যাই দেখা যাক না কেন, বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর তারা জিতে গেলেও এরদোগান ও তার সমর্থকরা কিভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভেতরে এবং বাইরে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে বিরোধীদের জেতার মধ্য দিয়ে কয়েক দশকের স্থিতির বিপরীতে অস্থিরতা আবার ফিরে আসতে পারে বলে গভীর ক্ষমতা বলয়ের অনেকে শঙ্কিত। বিরোধী দলের বিজয়ের ক্ষেত্রে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গভীরভাবে রাজনীতিকৃত আমলাতন্ত্র এবং আদালত ব্যবস্থাকে নিজেদের অনুক‚লে বিন্যাস করা পর্যন্ত বিস্তৃত চ্যালেঞ্জ আসবে। বিরোধী দলগুলোর মধ্যে প্রায়ই এরদোগানের প্রতি তাদের সমান ঘৃণার বাইরে খুব কম মিলই দেখা যায়। তবুও, অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টে, বিরোধীদের বিজয়ের ফলে অর্থনীতির আরো টেকনোক্রেটিক ব্যবস্থাপনা, কূটনৈতিক কোরে পেশাদার কর্মীদের পুনর্ব্যবহার এবং বিতর্কের জন্য আরো উন্মুক্ত পাবলিক স্পেস সৃষ্টি হতে পারে বলে বলে বিরোধী পক্ষ মনে করে। বৈদেশিক বিষয়ে, সিরিয়ান কুর্দিশ পিপলস প্রোটেকশন ইউনিট (ওয়াইপিজি) এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও সাইপ্রাসের সাথে মার্কিন সমর্থন নিয়ে উত্তেজনা সম্ভবত অব্যাহত থাকবে, তবে স্বল্পমেয়াদে নতুন নেতৃত্ব তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্কেত দিতে চাইবে যে, তারা সরল বিশ্বাসে কাজ করতে প্রস্তুত। আর বিরোধীরা জিতলে মার্কিন-তুর্কিয়ে সম্পর্ক সম্ভবত একটি মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করবে ও নতুন সরকার সম্ভবত ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে দ্রুত অগ্রসর হবে। সম্ভবত, এরদোগান পাঁচ বছরের মেয়াদে জয়ী হবেন, যা তাকে তার উত্তরাধিকার নির্মাণ করতে সাহায্য করবে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের মূল পথচলা পশ্চিমের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হওয়ার আকাক্ষায় গঠিত। এই আকাক্ষা জনগণের বড় অংশের মধ্যে যেমন রয়েছে তেমনিভাবে রয়েছে দেশটির গভীর ক্ষমতা বলয়েও। তারা এখনো তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এরদোগানের বিকল্প নেতৃত্ব ও একেপির বিকল্প দল খুঁজে পাচ্ছে না। অবশ্য সার্বিক বিবেচনায় নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, ২০২৩ সাল তুরস্কের জন্য হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct