এই সময়ে যেখানে পরবর্তীসাধারণ নির্বাচনের জন্য তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তেজনামুখর হয়ে থাকার কথা সেখানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিক্ষত দেশটি এখন শোকে বিহ্বল। সর্বশেষ খবর অনুসারে শুধু তুরস্কেই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। ঠিক এ সময় আরেকটি ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দেশটির ওপর। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়্যেপ এরদোগান ভূমিকম্প নিয়ে শিগগিরই ভাঙা শহরগুলো পুনর্গঠন কাজ শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। নতুন এই নতুন চ্যালেঞ্জা নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ প্রথম কিস্তি।
এই সময়ে যেখানে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের জন্য তুরস্কের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তেজনামুখর হয়ে থাকার কথা সেখানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিক্ষত দেশটি এখন শোকে বিহ্বল। সর্বশেষ খবর অনুসারে শুধু তুরস্কেই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। এর সাথে সিরিয়ার নিহতদের যোগ করা হলে জীবন ক্ষয় ৫০ হাজারের কোঠায় চলে যেতে পারে। ঠিক এ সময় আরেকটি ৬.৪ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে দেশটির ওপর। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়্যেপ এরদোগান কাহরামানমারাস ও এর ৯ প্রতিবেশী প্রদেশে আঘাত হানা ভূমিকম্প নিয়ে ২০২৩ সালের বিশ্ব সরকারপ্রধানদের এক শীর্ষ সম্মেলনে পাঠানো একটি ভিডিও বার্তায় শিগগিরই ভাঙা শহরগুলো পুনর্গঠন কাজ শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এরদোগান এই প্রলয়ঙ্করী ভূকম্পন প্রসঙ্গে বলেছেন, গত ৬ ফেব্রুয়ারি পর পর ৭.৭ এবং ৭.৬ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্পে আমরা মানবজাতির সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি। এক কোটি ৩৫ লাখ লোক অধ্যুষিত ১০টি প্রদেশের ৫০০ কিলোমিটার-বিস্তৃত অঞ্চলে ভূমিকম্প ব্যাপক ধ্বংস সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই ভূমিকম্পের ফলে নির্গত শক্তি ৫০০টি পারমাণবিক বোমার মতো। তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা শুধু আমাদের দেশের ইতিহাসের নয়, পুরো মানবজাতির ইতিহাসেরও সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী। আমরা যখন হাজার হাজার ধসেপড়া ভবনের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করছি, তখন ভূমিকম্পে শিকারের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বাড়ছে। ‘শতাব্দীর বিপর্যয়’ হিসেবে বর্ণনা করা এই দুর্যোগে বেঁচে যাওয়া ৮১ হাজারেরও বেশি মানুষকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল ধ্বংসস্তূপ থেকে আট হাজারেরও বেশি মানুষকে উদ্ধার করেছে।
তুরস্কের সরকার যেভাবে এই ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলা করছে তা নিয়ে নানা সমালোচনাও হচ্ছে। বিশেষত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ভূমিকম্প হয়তো এড়ানো যেত না। কিন্তু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া হলে প্রাণহানি আরো কমানো যেত। বিরোধী দল সিএইচপি প্রধান এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য এক ব্যক্তি এরদোগানকে দায়ী করেছেন। অন্য দিকে এরদোগান বলেছেন, আমরা আমাদের সব সম্পদ দুর্গত অঞ্চলে একত্রিত করেছি। আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানিয়ে লেভেল-৪ অ্যালার্ম ঘোষণা করেছি এবং ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছি। প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, আমাদের বেসরকারি সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবকরা দুর্যোগে বেঁচে যাওয়াদের সাহায্যে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। একদিকে অনুসন্ধান উদ্ধার এবং ধ্বংসস্তূপ অপসারণ করছি, অন্যদিকে তাঁবু, কনটেইনার ও প্রিফেব্রিকেটেড ঘর স্থাপনের মাধ্যমে জরুরি আশ্রয়ের কাজ ত্বরান্বিত করছি। আমরা শিগগিরই বিধ্বস্ত শহরগুলো পুনর্গঠন কাজ শুরু করব। রাষ্ট্র ও পুরো তুর্কিয়ে জাতিকে একসাথে নিয়ে আমরা এই বিপর্যয়ে সৃষ্ট ক্ষত দ্রুত নিরাময় করব ইনশাআল্লাহ।তুর্কিয়ে প্রেসিডেন্ট শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ শতাধিক দেশ থেকে পাওয়া সমর্থন ও শোকবার্তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরদোগান বলেছেন, বর্তমানে বৈশ্বিক ব্যবস্থা সঙ্কটে ঘেরা, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উভয় প্ল্যাটফর্মের তাৎপর্য এখন গুরুত্বপূর্ণ। এই সমীকরণে, তুরস্ক ও উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক একীকরণের একটি কেন্দ্রীয় অক্ষ গঠন করতে পারে। তুর্কিয়ে হিসেবে আমরা সবসময় বলি যে, আমাদের নিজস্ব স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা উপসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, মহাকাশ কর্মসূচি এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ছাড়াও, আমরা ভূমি ও রেল পরিবহন পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিই যা তুর্কিয়ের মাধ্যমে উপসাগরীয় অঞ্চলকে ইউরোপ ও এশিয়ার সাথে সংযুক্ত করবে।
এর আগে ১৯৯৯ সালে, ইস্তাম্বুলের কাছে কোকেলি প্রদেশে বিশাল ভূমিকম্প আঘাত হানে। তখনকার সরকার দুর্যোগ মোকাবেলায় অব্যবস্থাপনার পরিচয় দিয়েছিল। তৎকালীন ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টির (এমএইচপি) স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওসমান দুরমুস প্রাথমিকভাবে বিদেশী সাহায্যের অনেক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি তাদের একজন আহত ব্যক্তিকেও [দুর্গতদের সেবার] সুযোগ দেবো না; আমি তাদের রক্ত [দান] নেবো না।’ তখন সরকারিভাবে, ভূমিকম্পে ১৭ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছিল, তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। বাইরের সহায়তা প্রত্যাখ্যান করে একা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তখন এক ধরনের অব্যবস্থাপনা সৃষ্টি হয়। ইস্তাম্বুলের তৎকালীন মেয়র রজব তাইয়্যেপ এরদোগান এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি করার জন্য সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (একেপি) ক্ষমতায় আনতে সাহায্যকারী কারণগুলোর মধ্যে ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের বিপর্যস্ত প্রতিক্রিয়া একটি ছিল। এ কারণে একেপি সরকার এবারের দুর্যোগ মোকাবেলায় অধিকতর সতর্ক। যদিও বিরোধী পক্ষ সমালোচনার জোয়ার শুরু তুলেছে। সমালোচকদের একজন গবেষক ডিলেক তুর্কোজু উল্লেখ করেছেন, ‘ভূগোল হলো নিয়তি, কিন্তু অবহেলা একটি অপশন।’ ট্র্যাজেডি এড়ানো সম্ভব ছিল না; তুরস্কে ভূমিকম্প সাধারণ এবং পরবর্তী ‘বড় একটি’ শেষ পর্যন্ত আসার দিন পর্যন্ত সর্বদা দিগন্তের কোথাও অপেক্ষমাণ থাকে। এই মাসের প্রথম সপ্তাহে তুরস্ক ও সিরিয়াকে যে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল তা তার মাত্রায় মর্মান্তিক ছিল; কিন্তু সবাই জানত এটি আসছে। প্রত্যাশা ছিল এবারো সরকার প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু সেই প্রস্তুতি কতটা ছিল সেটি বড় প্রশ্ন। বিরোধী পক্ষ বলছেন, গত সোমবারের ভূমিকম্পের পরে প্রাথমিকভাবে সামরিক বাহিনীকে একত্রিত করা হয়নি। শুধু সরাসরি উদ্ধারে সহায়তা করার জন্য নয়, উদ্ধার প্রচেষ্টার জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ বা মেরামত করা, ফিল্ড হাসপাতাল এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিমান স্ট্রিপগুলোর মতো জিনিসগুলো শুধু সামরিক বাহিনীই কার্যকরভাবে করতে পারে। জরুরি ত্রাণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বেসামরিক অফিস দুর্বল অর্থহীন এবং সমন্বয়হীনভাবে পরিচালিত হয়েছে।তুরস্কের দুর্যোগোত্তর বাস্তবতা সে রকমটি মনে হয়নি। জাতির উদ্দেশে টেলিভিশন বক্তৃতায়, এরদোগান জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং এক সপ্তাহ জাতীয় শোক ঘোষণা করেন। তিনি সমালোচনা গ্রহণ করলেও ভিত্তিহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টির বিষয়ে সতর্কও করেন। উদ্ধার অভিযান চলাকালীন তুরস্ক টুইটার অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেয়; স্পষ্টতই, এটি ‘বিভ্রান্তি’ প্রতিরোধ করার জন্য করা হয়েছে বলে মনে হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct