বিপরীত স্বভাব
গোলাম মোস্তাফা মুনু
আরজিনা বিবি বিয়ের পর একদিনও স্বামীকে ভালোবেসে কথা বলেনি। তার মা-বাবা তাকে বহুবার বুঝিয়েছেন যে, স্বামীকে দুঃখ দিলে জান্নাত পাওয়া যাবে না, স্বামীকে ভালোবেসে চলতে হয়। কিন্তু তার একই কথা, ‘আমার ইচ্ছার বাইরে তোমরা বিয়ে দিয়েছো, আমি এর চেয়ে বেশি ভালো হয়ে চলতে পারবো না।’মেয়ের এমন মন্তব্য শুনে মা-বাবা নীরব থাকেন। মেয়েকে বেশি চাপ দিতে চান না। ফল বিপরীত হতে পারে। যদি হঠাৎ করে সে স্বামীর কাছ থেকে তালাক চেয়ে বসে! আরজিনার স্বামী মজিবুল খুবই সরল প্রকৃতির মানুষ।বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি। ক্লাস এইট পর্যন্ত। নিজের কিছু জমি-জায়গা রয়েছে, সেগুলোতে চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে। সংসারে খাবারের অভাব নেই। অভাব রয়েছে স্ত্রীর ভালোবাসার। তার পরিবারে স্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে একটা কাজও হয় না। বহু সাধ-আহ্লাদ মনের মধ্যে কবর দিয়ে রাখতে হয় মজিবুলকে। তবুও সে একরকম মনের আনন্দে আরজিনার সঙ্গে ঘর সংসার করতে থাকে। ভালোবাসা এবং নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তাদের বিবাহিত জীবন চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। কোনো সন্তান হয়নি। হঠাৎ করে আরজিনা ভাবতে শুরু করে তার সন্তান না হওয়ার কারণ। যেহেতু সংসারে কমপক্ষে একটাও সন্তান দরকার। পরের দিনই স্বামীকে সঙ্গে করে শহরে ছুটে যায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। ডাক্তার চিকিৎসা করে ওষুধ লিখে দিয়ে বলেন, পনেরো দিনের ওষুধ লিখলাম। ওষুধগুলো শেষ করে আবার আসবে। আর হ্যাঁ, কয়েকটা পরীক্ষা করতে হবে, সেগুলোও লিখে দিয়েছি। পরীক্ষাগুলো করিয়ে রিপোর্টগুলো সাথে আনবে।’
আরজিনা ধৈর্য হারিয়ে বলে ফেলে, ‘ডাক্তারবাবু, পরীক্ষাগুলো কি আজকেই করা যায় না?’‘ হ্যাঁ, করা যায়। কিন্তু আজকে তো হাতে রিপোর্ট পাবে না।’‘ডাক্তারবাবু, আর একদিন এসে রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে আপনাকে দেখিয়ে যাবো।’‘ঠিক আছে, তা-ই করো।’সেদিনই ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত রকম পরীক্ষা করিয়ে আরজিনা স্বামীকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে। সারাদিন শহরে থেকেছে এবং গাড়িতে যাতায়াত করেছে যার ফলে আরজিনা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে আর একবার স্বামীকে রাগ দেখিয়ে বলে, ‘যদি অন্য লোকের সাথে আমার বিয়ে হতো তাহলে হয়তো এতদিন আমার সন্তান হয়ে যেতো। আমার কপালটাই ভালো নয় তো আর কাকে কী বলবো!’ এ বলে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে শুনে মজিবুলের যেন সহ্য হয়ে গেছে। স্ত্রীর কথায় যেন আজকেও রাগ করল না। সে শান্ত স্বরে স্ত্রীকে বলে, ‘তুমি যে না খেয়েই শুয়ে গেলে? শরীর যে আরো খারাপ করবে?’ ‘তুমি খেয়ে শুয়ে যাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’ এ বলে আরজিনা চাদরখানা শরীরের উপর টেনে নেয়। মজিবুল কথা আর আগে না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো রান্নাঘরে গিয়ে থালায় খাবার নিয়ে খেতে শুরু করে। তিনদিন পর। স্বামীকে সাথে নিয়ে আরজিনা আবার শহরে যায়। ডাক্তারের নির্দেশমতো যেখানে সমস্ত রকম পরীক্ষা করা হয়েছিল সেখান থেকে রিপোর্টগুলো নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে আরজিনাকে তার অসুখ সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বলেন। আরজিনার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। সে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার অদূরেই অপেক্ষা করছিল মজিবুল। স্ত্রীকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘রিপোর্ট দেখে ডাক্তার কী বলল?’
আরজিনা খানিক কোমল সুরে বলে, ‘তোমার ওসব জেনে আর কী হবে!’ বলে সে হাঁটতে শুরু করল। প্রায় তিন বছর পর। ভীষণ অসুখে পড়ে যায় আরজিনা।পেটের অসুখ। আলসার। ওষুধ খাচ্ছে তবুও পেটের জ্বালা সহজে কমতে চায় না। প্রায় দু’মাস ধরে এমন রোগ ভোগ করতে থাকে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। একদিন রাত্রে স্বামীকে কাছে ডেকে সে কাতর স্বরে বলে, ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। আর একটা বিষয় গোপন করে রেখেছিলাম। তোমাকে জানাইনি। তুমি জানতে চাইলে তোমাকে আমি মিথ্যা...!’ আরজিনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মাজিবুল বলে ওঠে, ‘ওসব ভুলে যাও আরজিনা। তুমি আমাকে না জানালেও আমি সবই জানি। তোমাকে না জানিয়ে তোমার রিপোর্টগুলো অন্য ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম। সেই ডাক্তারের কাছে জানতে পারি যে, তুমি কখনো মা হতে পারবে না। আমার জেনে যাওয়াতে তুমি আরো বেশি কষ্ট পাবে ভেবে আমি তোমাকে আর কিছু বলিনি।’ ‘আমার এত বড়ো দুর্বলতা জেনেও তুমি এতদিন ধরে আমার দেওয়া দুঃখ সহ্য করে গেছো!’ আরজিনা বিস্ময়ের সুরে বলে কাঁদতে শুরু করল। এবার মজিবুলের চোখেও জল আসে। নিজের চোখের জল মুছে নিয়ে সান্ত্বনাচ্ছলে বলে, ‘তুমি কেঁদো না আরজিনা।তোমার অসুখ সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে আবারো আলোচনা করেছি। ডাক্তার বলেছে যে, তুমি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে একটু সময় লাগবে। আর তুমি আমার সাথে এতদিন যা ব্যবহার করেছো, তোমার এমনই স্বভাব মনে করে আমি এর পূর্বেই সব ক্ষমা করে দিয়েছি।’ স্বামীর এতবড় উদার মন অনুভব করে, আরজিনা মজিবুরের হাত দুটি ধরে, মুখের কাছে টেনে নিয়ে আবারও কাঁদতে শুরু করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct