এদেশে বর্তমান পরিষদীয় রাজনৈতিক দলগুলি নেতাজী সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তিনরকম মূল্যায়ণ করে থাকে। প্রথমত, কংগ্রেসি ঘরানার কাছে নেতাজী একজন বিগ্রহ বিশেষ। দ্বিতীয়ত, পরিষদীয় বামেদের কাছে নেতাজী অতি বিভ্রান্তিকর একটি বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার, তোজো এবং নেতাজী-পর্বটির রাজনৈতিক গুরুত্ব তাঁরা এখনও সম্যক বুঝতে পারেন না। তৃতীয়ত, যে নেতাজি-মূল্যায়ণ তার সূত্রপাত ২০১৪ থেকে। বিজেপি শিবির থেকে হিন্দুত্ববাদী নেতা রূপে নেতাজীকে প্রতিস্থাপনের এক বেপরোয়া উদ্যোগ শুরু হয়েছে। নেতাজির গৌরবকে আত্মসাৎ করার অপপ্রয়াস তারা চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে লিখেছেন প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. মনোজ গুহ।
এদেশে বর্তমান পরিষদীয় রাজনৈতিক দলগুলি নেতাজী সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে তিনরকম মূল্যায়ণ করে থাকে। প্রথমত, কংগ্রেসি ঘরানার কাছে নেতাজী একজন বিগ্রহ বিশেষ। নিয়ম করে প্রতি ২৩ শে জানুয়ারি তাঁরা সাড়ম্বরে নেতাজী-পূজা করেন। দ্বিতীয়ত, পরিষদীয় বামেদের কাছে নেতাজী অতি বিভ্রান্তিকর একটি বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার, তোজো এবং নেতাজী-পর্বটির রাজনৈতিক গুরুত্ব তাঁরা এখনও সম্যক বুঝতে পারেন না। যদিও নেতাজীকে ‘তোজোর কুকুর’ ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাকার গালমন্দ করাটা যে মানুষ ভালভাবে নেয়নি, এটা বুঝেছেন।তৃতীয়ত, যে নেতাজী-মূল্যায়ন তার সূত্রপাত ২০১৪ থেকে। বিজেপি শিবির থেকে হিন্দুত্ববাদী নেতা রূপে নেতাজীকে প্রতিস্থাপনের এক বেপরোয়া উদ্যোগ শুরু হয়েছে। কখনো সাভারকর ও নেতাজীকে একাসনে বসাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। কখনো শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে দিয়ে নেতাজীর গৌরবকে আত্মসাৎ করার অপপ্রয়াস তারা চালিয়ে যাচ্ছে। নেতাজী-মূল্যায়ণে এই আপাতবিরোধ থাকলেও একটি জায়গাতে এঁরা অভিন্ন। সেটা হচ্ছে ভোটের হাটুরে কারবারে নেতাজী সুভাষচন্দ্রকে মন্থন করা। কিন্তু সুভাষচন্দ্র যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করে গেছেন, আপোষহীন সংগ্রামী মানবাধিকারের যে আলোকশিখা জ্বালিয়েছেন, তাকে উপলব্ধির জন্য যে বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসবোধ থাকা দরকার, এই তিনটি শিবিরের সেই শিক্ষা নেই। তখন সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, অধ্যাপক ওটেন ক্লাসে ভারতের অপমান করলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ছাত্ররা প্রতিবাদ করে। সুভাষচন্দ্র বহিস্কৃত হন। পরে তিনি বলেছিলেন “আমায় বহিষ্কার করে আমার জীবনের ভবিষ্যত কলেজ কর্তৃপক্ষই তৈরি করে দেন। ... নেতৃত্বের স্বাদ আমি পেয়েছি। পেয়েছি আদর্শের জন্য দুঃখ বরণের আনন্দ “। এই আনন্দ একবার যাঁকে ধরে, তাঁকে জীবনের প্রচলিত ছকে ধরে রাখা যায় ? ছাত্রাবস্থাতেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, প্রকৃত দেশপ্রেম হোলো দেশের আর্ত, ব্রাত্য মানুষের জন্য নিঃসীম দরদ। কত প্রশ্ন তাঁকে ব্যাকুল করে। ১৯১৪ সালে সবান্ধব ছুটে গেছেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে। জানতে চেয়েছেন, কিভাবে পল্লীবাংলার সেবা করা যায়। কলেজের ছুটিতে কটকে গিয়ে কলেরায় পীড়িত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজনীতি আসলে এক উচ্চ হৃদয়বৃত্তি। আপোষহীন পথেই এই রাজনীতির চর্চা করতে হয়। এই সত্য তিনি কৈশোরেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে মাকে এক পত্রে লিখেছেন “আমি স্থির বুঝিয়াছি লেখাপড়া ছাত্রের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। চরিত্র গঠনই ছাত্রদের প্রধান কর্তব্য। আমি চাই চরিত্র, জ্ঞান, কার্য”। আরএক চিঠিতে মায়ের কাছে জানতে চেয়েছেন, জজ ব্যারিস্টার নাকি সত্যিকারের মানুষ, পুত্রকে কিভাবে দেখলে মা খুশি হবেন। আই সি এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান পেয়ে পাশ করলেন। উচ্চমানের সরকারী চাকরির মোহ অবলীলায় ভেঙ্গে দেশের কাজে যোগ দিলেন। আজকের এই আত্মমুখী সমাজে যা অচিন্তনীয়। ক্ষুদিরামের আত্মাহুতির মতো নায়কোচিত ঘটনাকে আজ ‘হঠকারী’ হিসেবে প্রচারের চেষ্টা চলছে। আনন্দবাজারের মতো ঐতিহ্যবাদী কাগজে এমন প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে। বর্তমান ভোগবাদী দুনিয়ায় মানুষ ভোক্তায় পরিণত হচ্ছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম সবই সেদিকে সোল্লাসে ছুটে চলেছে। ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং, মাষ্টারদা, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ মানুষ রাজনীতি, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগকে একাসনে বসিয়েছিলেন। আর আজ মানুষের সেবার কথা বলে বড় মেজো পরিষদীয় দলগুলি অবক্ষত পুঁজিবাদের দাসত্ব করছে। এবং নিজেরাই অবক্ষয়ের শিকার হয়ে চলেছে। মিথ্যাচার, প্রবন্চনাই এই রাজনীতির একমাত্র হাতিয়ার। সুভাষচন্দ্র তাঁর সময়ের এই আপোষকামী রাজনৈতিক ধারাকে চিনেছেন। বন্ধু দিলীপ রায়কে চিঠিতে লিখেছেন “ ওরা (বৃটিশরা) অহিংসা, সত্যাগ্রহ, চরকাকে ভয় পায় না। ভয় পায় বাঘাযতীন, কৃষ্ণ বর্মা, মাদাম কামা... এদের”। লিখেছেন “ দিলীপ, এই বিপ্লবীদের সঙ্গে তুমি মেশোনি.... এই ঘুমের দেশে শুধু এরাই জেগেছিল। এরা জেগেছিল বলেই কোটি কোটি তন্দ্রালুরা একটু আধটু আড়মোড়া ছাড়তে শুরু করেছে”। আবার আন্দোলনের নানা অভিজ্ঞতায়, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিঘাতে ‘বিপ্লব ‘ ও ‘সন্ত্রাস’ এ দুইয়ের পার্থক্যটাও উপলব্ধি করেছেন তিনি। বলেছেন “ Terrorism ও Revolution এক নয়। Terrorism মুষ্টিমেয় লোক দ্বারা সংগঠিত হইতে পারে। কিন্তু Revolution সম্ভব হইবে সেদিন, যেদিন সমগ্র জাতি জাগিবে। Revolution এর অর্থ অল্প সময়ের মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন “। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের সব্যসাচীও একই ভাবে বলেছিল “ বিপ্লব মানেই কাটাকাটি রক্তারক্তি নয়। বিপ্লব মানে দ্রুত আমূল পরিবর্তন “।
গান্ধীজীর রাজনীতি যে মালিক শ্রেণীর চিন্তার প্রতিফলন, এই সত্য সুভাষচন্দ্রের কাছে অচিরেই ধরা পড়েছিল। বিপরীতে ভগৎ সিং, নেতাজীর চিন্তায় মধ্যবিত্তের বিপ্লবী ধারা প্রতিফলিত। বলেছিলেন, “ দেখা যাচ্ছে কোটিপতিরাও নিজেদের দেশপ্রেমিক বলে জাহির করছে। ... জোতদার, শিল্পপতি, কোটিপতিরাই এখন কংগ্রেসী মন্ত্রীদের ঘিরে রেখেছে “ । স্বাধীনতার আন্দোলন সে কারণেই মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হতে পারেনি। এবং স্বাধীনতা-উত্তর ৭৫ বছর পরেও নেতাজীর সেই লিখন আরো প্রকট হয়ে শোভা পাচ্ছে। অবক্ষত পুঁজিবাদ যখন নিজেই নিজের বিষে ছটফট করছে, তখন সে বিষ পাল্টা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশে, সমাজে, পাড়ায়, গৃহস্থালিতে, প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে। নীতিনৈতিকতা, রুচি, মূল্যবোধের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাকেও সম্পূর্ণ লোপাট করে দেওয়া, এটাই এখন প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিপতিরা এখন প্রকাশ্যেই সেবাদাস রাজনৈতিক দলগুলির ভাঁড়ারে টাকা দিচ্ছে। আইনসভায় ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ নামে আইন করে এই ব্যবস্থাটি পাকা করা হয়েছে। মুনাফাখোর পুঁজিপতিদের কালো বেআইনি কোটি কোটি টাকা নিয়ে পরিষদীয় দলগুলি টাকা ছড়িয়ে ভোট কিনছে। এমনকি ভোটে হেরেও এই কালো টাকার জোরে বিরোধী জয়ী বিধায়ক/সাংসদ কিনে ক্ষমতাসীন হচ্ছে। নেতাজীকে এমন অধঃপাত দেখতে হয়নি। তিনি যে এমন এক ভবিষ্যতের আশঙ্কা করেননি তা নয়। বুঝেছিলেন আপোষের পথে মুক্তি আসবে না।বিশেষ করে বৃটিশের ‘ডিভাইড এন্ড রুল ‘এর রাজনৈতিক-সামাজিক বিপদ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলমানের মৌলবাদ, উভয় বিপদ সম্পর্কে নেতাজীর সম্যক ধারণা ছিল। ১৯২৮ সালে বলেছেন “হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ পরস্পরের পরিপন্থি একথা যাঁরা বলেন, তাহা ঠিক নয়। এদেশে খাদ্যাভাব, বেকারিত্ব, শিক্ষার অভাব এগুলি মূল সমস্যা। এই সব বিষয়ে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ এক ও অভিন্ন”। এমনকি হিন্দু-মুসলমানের আন্তঃধর্ম বিবাহকেও তিনি মঙ্গলজনক বলে মনে করতেন। আর সাম্প্রতিক স্বাধীন ভারতে কিছু রাজ্য ‘লাভ জেহাদ নিবারণী’ আইন পাশ করে মানুষের স্বাধীন সম্পর্ককে বিষাক্ত করছে। উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক ইত্যাদি বিজেপি শাসিত রাজ্যে এই আইন চলছে। নেতাজী ১৯৪০ সালে ‘ফরোয়ার্ড ব্লকে’র পত্রিকায় সরাসরি নির্দেশ দেন “ হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোন সদস্য কংগ্রেসের নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না “। হিন্দু মহাসভা, আর এস এস, মুসলিম লীগের মতো দলগুলি যে আগুন নিয়ে খেলছে, তখনকার জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত নেতাজীর মতো কেউই উপলব্ধি করতে পারেননি। ধর্মগুরুদের তন্চকতার দিক সম্পর্কে নেতাজীর চোখ খুলে গেছিল ছাত্রজীবনেই। তখন তিনি স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র। ইতিমধ্যে আধ্যাত্মিকতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁকে বেশ আলোড়িত করছে। আকৃষ্ট হচ্ছেন যোগধর্ম, শঙ্করাচার্যের মায়াবাদে। সন্ন্যাসধর্মের টানে, গুরুর খোঁজে ১৭ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করছেন। এক বন্ধুকে নিয়ে ঘুরছেন হরিদ্বার, মথুরা, কাশি, বৃন্দাবন। বিভিন্ন আখড়ায় ঘুরছেন। আশাহত হচ্ছেন ক্রমশ। দেখলেন এই সর্বত্যাগী গেরুয়াধারীদের মধ্যে ক্ষুদ্রতা, বিভাজন অস্পৃশ্যতা। এমনকি নানা রকমের হীন বাসনা। সন্ন্যাসধর্মের প্রতি আসক্তি চলে গেল। বিদেশীশাসকের হাতে স্বদেশবাসীর রক্তকে তিনি শঙ্করাচার্যের মায়া বলে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। পরে দিলীপ রায়কে লিখেছেন “ যোগ আর আধ্যাত্মবোধ আমি বুঝি না “। রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর বলেছিলেন “ খেতে না পেয়ে মানুষ মরবে আর আমি ধর্ম ধর্ম করব, ভগবানকে ডাকব, এমন ভগবানপ্রেমী আমি নই “। বিদ্যাসাগরের এই বলিষ্ঠ সেক্যুলার চিন্তাকে সুভাষচন্দ্র ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কংগ্রেসের মধ্যেও হিন্দু-মুসলমান বিভেদ প্রচ্ছন্ন ছিল। কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে হিন্দু-মুসলমানের পৃথক খাওয়া,থাকার প্রচলন ছিল। দেশবন্ধুর নেতৃত্বে যুবক সুভাষচন্দ্র এই ভেদ ঘোঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যেন সংযোগ না ঘটে “ ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত”। সুভাষচন্দ্র কখনো রামরাজত্বের কথা বলেননি। ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ বা ‘ঈশ্বর আল্লা তেরা নাম’ জাতীয় আধ্যাত্মগন্ধী বাচনিক কখনও তাঁর মুখে শোনা যায়নি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাপ্রধান হিসেবে পি কে সায়গল এবং শাহানওয়াজ খানকে নিযুক্ত করতে নেতাজীর কোন সমস্যা হয়নি। আর সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে যারা বিপুল ভোটে জিতে মন্ত্রীত্বের মসনদে বসেছে, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সুভাষচন্দ্র, নজরুলদের সম্পূর্ণ বিপরীতে ধর্মীয় রাষ্ট্রশক্তির নির্মাণ করে চলেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তি আজ রেনেসাঁর মর্মার্থকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করছে। দেশের বিভিন্ন আখাড়ার গৈরিক বসনধারী গুরুদের হাতে আজ রাজদন্ড। ‘জয় শ্রী রাম ‘ এখন এক রাজনৈতিক শ্লোগান হয়ে উঠেছে। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্ত করে তাদের গলায় মালা এবং ‘জয় শ্রী রাম’ শ্লোগান দিয়ে অভিনন্দিত করছে হিন্দু মহাসভার গেরুয়াধারীরা। গতবছর ২৩ শে জানুয়ারি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার খুব ধুমধাম সহ নেতাজীর জন্মদিন পালন করেছে। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার ভোট ছিল, সে কারণেই কোলকাতার ভিক্টোরিয়ায় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। প্রধানমন্ত্রীর সামনেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে অপদস্থ করবার জন্য কতিপয় বিজেপি কর্মী ‘জয় শ্রী রাম’ আওয়াজ দিতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্ম সম্মেলনের মন্চে উগ্র হিংস্রতা ছড়াচ্ছে ভন্ড সাধুসন্তদের নেতারা। সর্বত্রই এই বিশেষ শ্লোগানের উৎকট চিৎকার সাধারণ মানুষের মনে আতংক উৎপন্ন করছে। অথচ ১৯৩৯ এ নেতাজী সতর্ক করে গেছিলেন “ গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়া ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে।.... এই বিশ্বাসঘাতকদের রাষ্ট্রীয় জীবন হইতে সরাইয়া দিন” । নেতাজীর এই নির্দেশ সেদিন সত্য ছিল। আজ এ নির্দেশ সত্যতরো।
নেতাজী ১৯২৮ সালে মহারাষ্ট্রের এক সম্মেলনে দেশে “বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষার প্রয়োজন” এর কথা বলেছিলেন। কিন্তু ‘জাতীয়শিক্ষানীতি’র (২০২০) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার আর এস এসের এজেন্ডা অনুসারে শিক্ষার গৈরিকীকরণের ষড়যন্ত্র করছে। আড়াই হাজার বছর আগেকার জাতকের গল্প, পন্চতন্ত্র, গীতা ইত্যাকার পৌরাণিক বিষয়গুলিকে নতুন মলাটে হাজির করতে চাইছে। নীতিপাঠের আড়ালে শিক্ষার অভিমুখ সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা ছাড়া এটা অন্য কিছু নয়। ২০১৯ এ কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ভারতীয় শিক্ষা বোর্ড ‘ নামে বেসরকারী স্কুলের জন্য একটি পর্ষদ খোলা হয়েছে। আর এস এস পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে একটি অভিন্ন ছাতার নীচে নিয়ে আসাই এর উদ্দেশ্য। প্রাচীন সনাতনী শাস্ত্রের শিক্ষা দেওয়া এদের কাজ। এই পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ‘পতঞ্জলি যোগপিঠ ট্রাষ্টে’র মালিক বাবা রামদেব। গৈরিক বসনধারী এই গুরু এখন দেশের এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি। নেতাজী প্রমুখ মণীষীর আশঙ্কাকে সত্যে পরিণত করে বৃটিশ সহযোগী হিন্দুত্ববাদীরা এ দেশের জনগণকে আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধতে চলেছে। যারা আজীবন বৃটিশের সহযোগিতা করে গেল, তাদের কুলতিলক সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদেরকেও আজ এই দেশে, এমনকি এই বাংলায় নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পাশে স্থান করে দেওয়ার অপপ্রয়াস চলছে। যারা এই ধুর্ত চেষ্টায় মত্ত, তাদের সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকা দরকার। সজাগ থাকা দরকার তাদের সম্পর্কে যারা এই দেশবরেণ্য মণীষীর বিরুদ্ধে কুৎসিত নিন্দা করে নিজেরাই ইতিহাসের ভারবাহীতে অধঃপতিত হয়েছে। ২ য় বিশ্বযুদ্ধে নেতাজী প্রথমে সামরিক সহযোগিতার জন্য গেছিলেন সোভিয়েতের কাছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের রক্ষার জন্য মিত্রশক্তির সহায়তা স্টালিনের যথার্থই প্রয়োজন ছিল। এই বাস্তবতা নেতাজী বুঝতে পারেন। তখন তিনি হিটলার মূসোলিনীর কাছে যান। কখনোই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেন নি। ১৯৪৫ এ সিঙ্গাপুর থেকে বেতার ভাষণে বলেছিলেন, জাপান ও সোভিয়েতের যুদ্ধের চরিত্র এক নয়। এটা ঠিক ফ্যাসিস্টদের শৃংখলিত টানটান স্ট্রাকচার দেখে প্রাথমিক কিছুটা বিভ্রান্তি তাঁর হয়েছিল। তখনকার সি পি আই এই তাৎক্ষণিক ভ্রান্তিকে বড় করে দেখে। কিছু পরে রজনী পাম দত্তের কাছে তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। বলেছেন, হিটলারের নাৎসী দর্শন দুর্বল বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসোলিনীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর রবীন্দ্রনাথেরও ক্ষণিকের ভ্রান্তি জন্মেছিল। পরে রমা রঁলার কাছে তিনিও ভুল স্বীকার করেন। এই সি পি আই ও সোস্যালিস্টদের রাজনৈতিক আপোষের জন্যই সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে কার্যত বিতাড়িত হতে হয়। কুখ্যাত পন্থ প্রস্তাবের ভোটাভুটি কমিউনিস্ট নামধারী পার্টি ও সোস্যালিস্টরা বয়কট করে। অনিবার্য কারণেই সভাপতি হিসেবে সুভাষচন্দ্রের সমস্ত সাংগঠনিক ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। হতাশ সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে, কমিউনিস্ট নামধারী একটি দল সুবিধাবাদের কাছে দেশের চূড়ান্ত প্রয়োজনের মুহূর্তে কিভাবে নত হতে পারে ! এদের এই আচরণ দেখেই তিনি বলেছিলেন, বামপন্থীদের মতো কথা এবং দক্ষিণপন্থীদের মতো আচরণ, এটাকেই বলে সুবিধাবাদ। এমন নানা কারণে সুভাষচন্দ্র একটি আপোষহীন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন। কারণ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেশের ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন স্বাধীনতা পাওয়ার পরেও আর একটি স্বাধীনতার আন্দোলন করতে হবে। বৃটিশ মুক্ত ভারতে, শ্রেণীশোষণের অবসানের জন্য আরো বৃহত্তর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। সেই মুক্তিসংগ্রামের অনুকূল একটি নতুন রাজনৈতিক দল চাই। নেতাজী সুভাষচন্দ্র কমিউনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপযোগী এক উন্নত, বলিষ্ঠ চরিত্র হয়ে তিনি এখনও বিরাজ করছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct