প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বমতের প্রতি সংবেদনশীল। কেননা, মোদি নিজে বহির্বিশ্বের সমর্থন কামনা করে থাকেন। ক্ষমতাসীন বিজেপি বরাবরই এই দাবি করতে পছন্দ করে যে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত যেভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেয়েছে, তা তাঁর পূর্বসূরিদের কপালে জোটেনি। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় বিশ্ববাসী ভারত সম্পর্কে যা বলছে, তাতে প্রশংসার কিছু মিলছে না এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি সরকারও একেবারেই ছেলেমানুষের মতো আচরণ করছে। সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ শিরোনামে বিবিসির সম্প্রচার করা একটি তথ্যচিত্রে মোদির ভাবমূর্তি ক্ষতির মুখে পড়া নিয়ে বিচলিত হয়ে সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বিবিসির কড়া সমালোচনা করেছেন। এ নিয়ে লিখেছেন শশী থারুর।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বমতের প্রতি সংবেদনশীল। কেননা, মোদি নিজে বহির্বিশ্বের সমর্থন কামনা করে থাকেন। ক্ষমতাসীন বিজেপি বরাবরই এই দাবি করতে পছন্দ করে যে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত যেভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা পেয়েছে, তা তাঁর পূর্বসূরিদের কপালে জোটেনি। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় বিশ্ববাসী ভারত সম্পর্কে যা বলছে, তাতে প্রশংসার কিছু মিলছে না এবং এর প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি সরকারও একেবারেই ছেলেমানুষের মতো আচরণ করছে। সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ শিরোনামে বিবিসির সম্প্রচার করা একটি তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। ওই তথ্যচিত্রে গুজরাটে ২০০২ সালে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় সহস্রাধিক মুসলমানকে হত্যা করার ঘটনায় মোদির সম্পৃক্ততা তুলে ধরা হয়েছে। এটি প্রচারের পর সরকার চূড়ান্ত রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। মোদির ভাবমূর্তি ক্ষতির মুখে পড়া নিয়ে বিচলিত হয়ে সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা বিবিসির কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ভারত জি-টোয়েন্টির সভাপতির পদ নেওয়ার প্রাক্কালে ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিবিসি এই তথ্যচিত্র সম্প্রচার করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এটিকে ‘একটি বিশেষ কুখ্যাত ভাষ্যকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে বানানো প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সরকার এই তথ্যচিত্র যাতে সাধারণ মানুষ সহজে দেখতে না পারে, এ জন্য জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে টুইটারকে তথ্যচিত্রটির লিংক মুছে ফেলতে ইউটিউবকে এটি আপলোড না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। মোদি সরকার ছোটখাটো পাল্টা আঘাত করা থেকেও বিরত থাকেনি। নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে বিবিসির কার্যালয়ে সরকারি কর কর্মকর্তারা তল্লাশি অভিযান চালিয়ে সেখানকার কর্মীদের ফোন ও ল্যাপটপ জব্দ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেক দফা আঘাত হানার একটি নজির তারা রেখে গেছে।
গত নভেম্বরে বিজেপি-সমর্থিত বিতর্কিত ছবি দ্য কাশ্মীর ফাইলস (যার কল্পিত কাহিনি একজন যুবককে ঘিরে, যে গল্পের একটা পর্যায়ে জানতে পারে, তার কাশ্মীরি হিন্দু পিতা-মাতা সেখানকার ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হাতে মারা পড়েছিল) সম্পর্কে ইসরায়েলের চিত্রনির্মাতা নাদাভ লাপিদ সমালোচনা করার পর কর্মকর্তারা ঠিক একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ইন্ডিয়ার জুরিবোর্ডের সভাপতি হিসেবে দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি দেখে সেটিকে ‘স্থূল প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং প্রতিযোগিতার ক্যাটাগরিতে ছবিটি স্থান পাওয়ার যোগ্য নয় বলেও মন্তব্য করেছিলেন।এর প্রতিক্রিয়ায় মোদি সরকার লাপিদের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে পাল্টা আঘাত হানে। তারা তাঁর বিরুদ্ধে কাশ্মীরি পণ্ডিতসমাজকে খাটো করার অভিযোগ এনে তাঁকে জুরিবোর্ড থেকে বের করে দেয় এবং লাপিদের মন্তব্যের নিন্দা জানাতে ভারতে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে চাপ দেয়। এটা ধরেই নেওয়া যায় যে বিজেপি সরকার যত দিন ক্ষমতায় আছে, তত দিন লাপিদ ভারতে আসার জন্য ভিসা চাইলে তাঁকে ভিসা দেওয়া হবে না। মোদির সরকার দেশের জাতীয় সম্মান রক্ষার বাধ্যবাধকতার কথা বলতে গিয়ে বারবার সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উগরে দেওয়ার কাজটিই করে যাচ্ছে। জাতীয় সম্মান অত্যন্ত দামি জিনিস; কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সব কথাই যে সেই জাতীয় সম্মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা মোটেও নয়। অতি ছোটখাটো প্রতিটি বিষয়েও এত শক্ত ও মারমুখী প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মানেটা দাঁড়ায় যে ভারতের জাতীয় সম্মান গভীরভাবে প্রোথিত ও টেকসই নয়, বরং তা একেবারে ভঙ্গুর ও অমূলক। তথ্য ও পরিসংখ্যানকে ধামাচাপা দিয়ে শুধু প্রশংসাসূচক ভাষ্য বজায় রাখার চেষ্টা ভারতের দারিদ্র্য পরিসংখ্যান থেকে শুরু করে ভারতে চীনা অনুপ্রবেশের বিশদ বিবরণসহ সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। এই চেষ্টা ভারতের জাতীয় নীতিকেও খাটো করতে পারে। মোদি সরকার, বিশেষ করে বাইরের দেশের মানুষের ভারত-সংক্রান্ত ধারণার বিষয়ে বেশ আগ্রহী। সরকারের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা, বিশেষ করে বিদেশিদের সমালোচনাকে সবচেয়ে বেশি ভয়। ভারতের অতি যত্নে গড়ে তোলা বৈশ্বিক ভাবমূর্তি রক্ষায় মোদি সরকারকে আগের যেকোনো সরকারের চেয়ে বেশি তটস্থ দেখা যাচ্ছে। আগের সরকারগুলো ভারত-সংক্রান্ত যেসব সমালোচনা অবলীলায় এড়িয়ে যেত, মোদির সরকার তার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। কিন্তু ভারত সরকারকে শুধু সমালোচনা সহ্য করলে হবে না, বরং কট্টরবাদকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখে, এমন লোকদের ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগও করে দিতে হবে। সব ধরনের সমালোচনাকে অবৈধ প্রতিপন্ন করা পরিপক্ব নয়, বরং তা নামমাত্র গণতন্ত্রের পরিচায়ক।
সৌজন্যে: প্র. আ.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct