বাংলার মুসলমানরা মুসলিম প্রার্থী দেখে ভোট দেন না। রাজনীতি দেখে ভোট দেন। আসানসোলের কহো না প্যার হ্যায় খ্যাত সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে ভোট দেন বিপরীতে যোগ্য মুসলিম প্রার্থী থাকলেও। গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পূর্বেকার মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে প্রার্থী করলেও মুসলমানদের গোঁসা হয়নি। কেননা, মুসলমানরা জানেন, মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা বাড়লেই যে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে এমন না। মুসলিমদেরঅন্য দলকে ভোট দেওয়ার কোনো উপায় নেই। এটা তাাদের নিরুপায়তা মনে করলে ভুল হবে। এ নিয়ে লিখেছেন কাজী খায়রুল আনাম।
গত বিধানসভা নির্বাচনে মুসলিম ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের কুর্সি বাঁচাতে প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিল। কারণ অনুপ্রেরণার রাজনীতি উল্টো রথে চড়ে বসেছিল। সম্প্রীতির বাংলায় সাড়ে তিন কোটি মুসলমানদের অধিকাংশই ঐতিহ্য রক্ষায় শামিল হয়েছিলেন। রাজনীতির স্মৃতি দূর্বল হতে পারে, ইতিহাস স্মরণ রাখবে। অন্যদিকে কেউ বলতেই পারেন, আরও দুটি কারণ মনে রাখতে হবে। প্রথমত বিনি পয়সার চাল। দ্বিতীয়ত এনআরসি’র ভুলভুলাইয়া। কিন্তু তাতেও এসে যাবে বাংলার ভালো থাকার কথা। কেননা, পঁয়ত্রিশ শতাংশ মুসলমান ভালো না থাকলে বাংলা ভালো থাকবে কীভাবে? প্রসঙ্গত, বাংলার মুসলমানরা মুসলিম প্রার্থী দেখে ভোট দেন না। রাজনীতি দেখে ভোট দেন। আসানসোলের কহো না প্যার হ্যায় খ্যাত সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে ভোট দেন বিপরীতে যোগ্য মুসলিম প্রার্থী থাকলেও। গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল পূর্বেকার মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে প্রার্থী করলেও মুসলমানদের গোঁসা হয়নি। কেননা, মুসলমানরা জানেন, মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা বাড়লেই যে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে এমন না। প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় শান দিয়ে গেছে রাজনীতি। এবং পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, মুসলমানদের অন্য দলকে ভোট দেওয়ার কোনো উপায় নেই। এটা মুসলমানদের নিরুপয়তা মনে করলে ভুল হবে। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য মুসলিম প্রার্থীর প্রয়োজন হয় নি কোনোদিনই। গণতান্ত্রিক ভারতে বা বাংলাতেও মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় ভোট দেওয়ার নজির নেই। তা হলে আবার কোনো দল মুসলিম লিগের মতো মাথা তুলে মুসলমানদের মাথা হেঁট করে দিত। ভারতে মুসলমানদের যেক’টি দল আছে তারা ভোটের অপুষ্টিতে ভুগত না। এটা ঠিক, মুসলমানরা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এবং শাসক দলে থাকার চেষ্টা করে। ফলে, যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলই ধরে নেয়, মুসলিম ভোট যাবে কোথায়? প্রয়োজন বাড়তি ভোট। স্বাভাবিক ভাবে, তারা নরম-গরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে। মুসলিম সমাজের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথাও ভাবে না। বামফ্রন্ট সরকার আলিয়া ক্যাম্পাস, হজ ক্যাম্পাস, মিলন মেলার আয়োজনে তাদের সীমিত ক্ষমতা সীমিত রেখেছিল। সাচার বিধৌত মুসলিম মন পেতে সেও ছিল এক অনিচ্ছুক প্রেম। তারপর বাঘের গরুতে জল খাওয়ার বহু দৃশ্য দৃশ্যমান হয়েছে বাংলার রাজনীতিতে। পরিবর্তিত বাংলায় একা মুসলমানদের পরিবর্তন মুসলমানরাও চাননি। তথাপি বাংলার মুসলমানরা কেমন আছেন জানতে, হাতে বিনি পয়সার চালের থলি নহে আলিয়ায় উঁকি মেরেও দেখিতে পারেন। তারপরও মুসলমানরা ভোটদাতা শুধু চাল গ্রহীতার বলে নয়। শান্তির বাংলাকে শান্ত রাখতে চাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই আছে। এটা ঘটনা যে, পরিবর্তনের সরকার আসার পরেও মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, উত্তর দিনাজপুর ও বীরভূমে কংগ্রেসের একটা জনাধার ছিল। যা মুসলিম ভোট কেন্দ্রীক। কংগ্রেস সাংসদ, বিধায়ক ও নেতাদের দল বদলের পরেও কিছুটা ছিল। কিন্তু বিজেপির সি এএ ও এনআরসি’র কারণে সেই ভোটের সিংহভাগই চলে যায় তৃণমূলে। কারণ মুসলমানরা মনে করেছিলেন, এখনও করেন - বাংলায় বিজেপিকে হারাতে পারে একমাত্র তৃণমূল। পারলে তৃণমূলই পারে এনআরসি থেকে বাঁচাতে। এরফলে মুসলমানদের ঈমান-আমালের ব্যালেন্স দ্রুত শেষ যাচ্ছে কিনা বিশেষজ্ঞ - এক্সপার্টরা বলতে পারবেন। তবে ‘যাবে কোথায়’ মনোভাবের শিকার হয়ে পড়েছে। একটা উল্টো হিসাব আছে, গত লোকসভা নির্বাচনে বামেদের ভোটের সিংহভাগ চলে গিয়েছিল বিজেপির দিকে। কেননা, লোকসভায় বামেদের ভোট দেওয়ার অর্থ ভোট নষ্ট করা। তারা সরকার গঠন করার পর্যায়ে ছিল না। অতীতে সেই পর্যায়ে গিয়েও তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। আবার রাজ্যস্তরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও আন্দোলনও তাঁরা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন নি। ফলে, তৃণমূল বিরোধী মানুষ ভোট দিয়েছিলেন বিজেপিকে। বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ভোট লোকসভার মতো পদ্ম পাতায় নিরাপত্তা খুঁজতে যায় নি। তবে হিন্দু ভোট কিছু যেমন বিজেপির দিকে গেছিল। তেমনই বামেদের মুসলিম সমর্থকদের ভোট গিয়েছিল তৃণমূলের দিকে। তারপর বাম-কংগ্রেস এক তৃতীয়াংশ আসনে নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারার জন্য তৃণমূলের জয় অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
মুসলমানদের বেশিরভাগ ভোট তৃণমূলের দিকে গেলেও কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, আই এস এফ, বিজেপির দিকেও গেছে। তবে সেই ভোট তৃণমূল ছাড়া বাকিদের রাজ দখলের সহায়ক হয়ে ওঠে নি। স্বভাবতই, তৃণমূল কংগ্রেসের অবশ্য এখন আর শ্যাম রাখি না কূল রাখি রাজনীতির প্রয়োজন নেই। বিজেপি বাংলার রাজনীতিতে যেভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে তাতে মুসলমানদের ভোট আপনা হতেই বেশিরভাগটা তৃণমূল কংগ্রেসে পড়বে। যেমন দিল্লি, পঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, গুজরাতে পড়েছে কেজরিওয়ালের ঝাড়ুতে। এরপর মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক ভাবে ভোট দেন না, না তাঁরা রাজনীতির পাটিগণিতে কাঁচা? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। পরাধীন ভারতে বাংলার মুসলমানরা মুসলিম লীগকে সমর্থন করেননি। গঠিত হয়েছিল শ্যামা - হক মন্ত্রীসভা। স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কোনও মুসলিম দল বা জোটকে সমর্থন করেন নি। মুসলিম সমর্থনের অভাবে দলগুলি বিলীন হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলার বুকে সবচেয়ে জোরে যে সম্প্রীতির আওয়াজ শোনা যায়, সেই কোরাসে মুসলমানদের কন্ঠও আছে। আজ বাংলার মুসলমানদের বেশিরভাগটাই বিজেপির বিরোধী তা অবশ্যই রাজনৈতিক। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনও মোহ না থাকলেও ব্যবহারিক রাজনীতির প্রবণতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সেটা আর্থ-সামাজিক অবস্থার নিরিখে। তাহলে চালের থলি, পাঁচশো টাকার ব্যাপারটা এসেই গেল? মুসলমানদের অবস্থাটা এখন আর ঠিক এই পর্যায়ে নেই। দেশে বিদেশে খেটে খুটে তাঁরা একটা পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন। ‘ অর্থপূর্ণ শিক্ষা’র জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে পুরো সমাজ। এরপরেও অবশ্য রাজনীতির অপরাধে মুসলমানদের এখনও ডাকলে পাওয়া যাচ্ছে, এটা ঘটনা। কারণটা হচ্ছে, ‘যোগ্যতাহীন গুরুত্ব ‘লাভের আশা। অযোগ্যদের ব্যবহার করে রাজনীতি করা রাজনীতির দস্তুর। তার শিকার শুধুমাত্র মুসলমানরা নন, অন্যরাও। মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতি করাটা সহজ এই কারণে তাঁদের বায়নার ঝক্কিটা কম। মুসলিম রাজনৈতিক নেতারাও যেকোনো দলেই অনুগ্রহ প্রার্থী হিসাবে থেকে যান। কারণ জাতিগত জনাধার তাঁদের সঙ্গে থাকে না। এই কারণে তাঁদের অনুগ্রহ প্রার্থী হিসাবে থাকতে হয়। স্পষ্টত, মুসলমানদের যেকোনো আন্দোলন বা অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সাম্প্রদায়িক তকমা পেয়ে যায়। ফলে মুসলমানরা সেটাকেও এড়িয়ে চলেন। অস্তিত্বের লড়াই ভেবে এনআরসি’র হুঙ্কারে বিভ্রান্ত হয়ে মুসলমানরা ভুল আন্দোলন করে দিল্লি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হারিয়েছে অনেক কিছুই। আজ ভোটের অধিকারটাই শুধু মুসলমানদের বাকি সবটাই রাজনীতির। দিনের শেষে নিশান গুটিয়ে রেখেও মুসলমানরা অনুগ্রহ প্রার্থী! পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩৫ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট ভোটের ময়দানে অবশ্যই বিরাট ফ্যাক্টর। সামাজিক অনুন্নয়নের কারণে বেশিরভাগটাই শাসক দলের পক্ষে থাকলেও বাংলার মুসলিম ভোট পুরোটা তৃণমূলের জনাধার নয়। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, আই এস এফ প্রভৃতি দলের মুসলিম কর্মী সমর্থকদের সংখ্যা কম নয়। ফলে, পশ্চিমবাংলার বুকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঠাঁই হওয়া মুশকিল। বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ, মানুষ ভোট দেন সাধারণতঃ প্রতীক দেখে। এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাটা কম না। কংগ্রেস থেকে যুক্তফ্রন্ট। বামফ্রন্ট থেকে তৃণমূল একই ধারা অব্যাহত। বস্তুত, প্রতীক যেখানে ফ্যাক্টর সেখানে সম্প্রদায়গত ভোটের তত্ত্ব আসে কি? মুসলমানদের ভোট ভূমিকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নেই। তবে অবিমৃশ্যকারিতার উৎসাহ আছে, - এটা তো মানতেই হবে!
All Rights Reserved © Copyright 2025 | Design & Developed by Webguys Direct