আমাদের রাজ্যের শাসকরা তাঁদের উপর বাংলা শেখার ফরমান জারি করতে পারেননি। তাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য বাঙালিরা হিন্দি বলছেন, ভাঙা বাংলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভাঙা হিন্দি। ভেঙে মোর ভাষার চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে? তার উপর আমাদের কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর চালু করতে চলেছেন, ‘দেশ এক এক ভাষা’ নীতি। সেই এক ভাষাটি হিন্দি। অনেকদিন ধরে এমন একটা ভাব তৈরি করে রাখা হয়েছে যেন হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা। সংবিধানে ঠিক কি লেখা আছে, তা কে জানতে যায়? এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।
বাবুমশাই রেডি হচ্ছেন তো? এসে গেল যে। একুশে ফেব্রুয়ারি। আপনি বোধহয় এতক্ষণে গুণগুণ করে গান শুরু করে দিয়েছেন, ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ তারপরে স্নানটান করে তৈরি হবেন। ধুতি-পঞ্জাবি পরবেন। অসুবিধে হবে। এসব পরা তো অভ্যেস নেই। বাঙালি যে আন্তর্জাতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ। তাই বাঙালির পোশাক, বাঙালির খাদ্য, বাঙালির আচার-আচরণ সব ভেসে গেছে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আপনি যাবেন সভায়। ভাষা শহিদদের ফুলমালা দেবেন। তারপরে বক্তৃতা শুরু করবেন। ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ বলে শুরু করে মাতৃভাষার পক্ষে বলে যাবেন অজস্র কথা, ভাষা সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে অগ্নিগর্ভ হবে উঠবে আপনার ভাষণ। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনবে। বাবুমশাই ৩৬৫ দিনে বছর। সেই ৩৬৫ দিনে একুশে ফেব্রুয়ারি আসে মাত্র একটি দিন। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয় ওই একটি মাত্র দিনে। বাকি ৩৬৪ দিনে আপনারা তাকে বেমালুম ভুলে যান। ভুলে গিয়ে ছেলে—মেয়েকে ভর্তি করে দেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। কোন দুর্মুখ বন্ধু যদি আপনার দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন করে, তাকে বলেন, ‘ কি করব ব্রাদার, ফ্যামিলির অর্ডার, ট্রিমেন্ডাস প্রেসার। তার কাছে সাবমিট করতে হয়। ’ বাবুমশাই, বন্ধুকে যে বাক্যটি বললেন, তাকে কি বাংলা ভাষার বাক্য বলা যায়? সে বাক্যের ১২টি শব্দের মধ্যে ৬টি ইংরেজি শব্দ। আপনি তখন নিশ্চয়ই বলবেন যে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করলে ভাষা শক্তিশালী হয়। ঠিক কথা। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ খুব কম নেই। সুকুমার সেন বা অন্য কোন ভাষাতাত্ত্বিকের বই খুললে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আকছার বিদেশি শব্দ( এবং বাক্যাংশ) ব্যবহার করলে আপনার মাতৃভাষা কি বেশিদিন জ্যান্ত থাকতে পারে? রাস্তা-ঘাটে কান পাতলে এ রকম খিচুড়ি বাংলা শুনতে পাবেন। রেডিয়ো-টি্ভিতে, ফেসবুকের চ্যাটিংএ খিচুড়ি বাংলার স্রোত বয়ে চলেছে।
আমার বড় আশ্চর্য লাগে বাবুমশাই। ইংরেজি-নবিশ একটা সম্প্রদায়কে আমরা পেয়েছি উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। তারপরে তো সে সম্প্রদায় ভেসে গেল স্বাদেশিকতার জোয়ারে। বাঙালিয়ানার সাধনা শুরু হল। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও ছিল তার প্রভাব। তাহলে কবে থেকে শুরু হল ইংরেজিয়ানা? ১৯৮৬ সালে তখনকার সরকারের ভুল ভাষানীতি কি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার ব্যাপারটাকে উসকে দিয়েছিল অজান্তে? না, শুধু ভুল শিক্ষানীতি বোধহয় নয়। জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়নের ফলে চাকরির বাজারে মন্দা দেখা দিল। বাড়তে লাগল বেকার সমস্যা। ইংরেজি নবিশ হলে চাকরির বাজারে ছিটে-ফোঁটা সুবিধে হতে পারে বলে মনে হল। তারপরে এসে জুটল হিন্দি। গোদের উপর বিষফোঁড়া আর কি ! হিন্দি সিনেমার প্রভাব তো ছিলই। তার সঙ্গে যুক্ত হল হিন্দিভাষীদের প্রভাব। একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ। আবার বলছি আমরা আন্তর্জাতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ। তাই ভিন্ন প্রদেশের মানুষ এ রাজ্যে এসে চুটিয়ে ব্যবসা করতে লাগল,। তা করুক। বাঙালি ব্যবসা বিমুখ। করবে না কেন? আচার্য প্রফুল্ল রায় মশায় বাঙালিকে ব্যবসা্য় লাগাবার জন্য কত সদুপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। সব বৃথা হয়েছে। ভিন্ন প্রদেশবাসী এ রাজ্যে ব্যবসা করতে এসে নিজেদের ভাষা –সংস্কৃতি অব্যাহত রেখেছেন। আমাদের রাজ্যের শাসকরা তাঁদের উপর বাংলা শেখার ফরমান জারি করতে পারেননি। তাই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য বাঙালিরা হিন্দি বলছেন, ভাঙা বাংলার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভাঙা হিন্দি। ভেঙে মোর ভাষার চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে? তার উপর আমাদের কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর চালু করতে চলেছেন, ‘দেশ এক এক ভাষা’ নীতি। সেই এক ভাষাটি হিন্দি। অনেকদিন ধরে এমন একটা ভাব তৈরি করে রাখা হয়েছে যেন হিন্দি আমাদের রাষ্ট্রভাষা। সংবিধানে ঠিক কি লেখা আছে, তা কে জানতে যায়? তাই এখনকার বাংলা যেন ইংরেজি ও হিন্দি মিশ্রিত এক খিচুড়িভাষায় পরিণত হয়েছে। তা বাবুমশায়, বাংলা ভাষার ঢক্কানিনাদ না করে আসুন আমরা সেই মুমূর্ষুকে পবিত্র গঙ্গাতীরে নিয়ে যাই, কলুষনাশিনীর কৃপায় তার মুক্তি ঘটুক।
লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct